ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশিয়াসন, যা সাধারণত হরে কৃষ্ণ আন্দোলন নামে পরিচিত, একটি গৌড়িয়া বৈষ্ণব হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন। এই সংগঠনটি এ. সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই, নিউ ইয়র্ক সিটিতে।
ইসকন কোন ধরনের সংগঠন?
ইসকন একটি ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন। এটি একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক সংগঠন, যার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে ঈশ্বর শ্রী কৃষ্ণের প্রতি সমর্পিত হওয়া এবং তাদের জীবনকে আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করা। এটি ১৯৬৬ সালে ভারতীয় ধর্মগুরু আচার্য প্রভুপাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রভুপাদ তাঁর জীবন এবং শিক্ষা দিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে ভগবদ গীতা, শ্রীমদ্ভাগবতম ও অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মহিমা প্রচার করেন। এই সংগঠনটি আজ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সক্রিয়।
ইসকন অর্থ কি?
ইসকন (ISKCON) শব্দটি International Society for Krishna Consciousness এর সংক্ষিপ্ত রূপ। বাংলায় এর অর্থ হলো “শ্রী কৃষ্ণের প্রতি সচেতনতা বিস্তারকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন”। এক কথয় ইসকন মানে হচ্ছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ।
ইসকনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে শ্রী কৃষ্ণের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি করা। এটি মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কাজ করে। তারা বিশ্বাস করে যে, কৃষ্ণই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ ঈশ্বর, এবং তাঁর কাছে সমর্পণই মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ইসকনের মাধ্যমে মানুষ তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করে এবং জীবনে শান্তি ও আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করে।
ইসকন কী কাজ করেন?
শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক চর্চা
- ভগবদ গীতা ও শাস্ত্রের পাঠ: ইসকন বিশ্বজুড়ে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা, শ্রীমদ্ভাগবতম ও অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা প্রচার করে। তারা এই গ্রন্থগুলির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রদান করে এবং মানুষকে ঈশ্বরের প্রতি অনুগত হতে উদ্বুদ্ধ করে।
- সংকীর্তন: ইসকন প্রচার করে মন্ত্রজপ বা সংকীর্তন (শ্রী কৃষ্ণের নাম উচ্চারণ), যার মাধ্যমে ভক্তরা আত্মিক শান্তি এবং মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়।
ভক্তি ও কৃষ্ণ সেবা
- ইসকন সদস্যরা শ্রী কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেবা করতে উৎসাহী। তাদের কর্ম হলো কৃষ্ণের প্রতি প্রেম এবং আত্ম-শুদ্ধির জন্য জীবনকে সমর্পণ করা।
- মন্দিরের সেবা: ইসকন মন্দিরগুলিতে নিয়মিত পূজা, আরতি, এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সদস্যরা মন্দিরে আসার মাধ্যমে কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে।
- শুদ্ধ আহার: ইসকন খাদ্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও শ্রী কৃষ্ণের প্রতি সমর্পিত থাকে। তারা “প্রসাদ” (শ্রী কৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করে প্রস্তুত করা খাবার) বিতরণ করে, যা ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক খাবার।
সমাজসেবা
- দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য: ইসকন বিভিন্ন দেশে দরিদ্রদের জন্য খাবার বিতরণ করে। এর মধ্যে হরিবোল প্রকল্প বা প্রসাদ বিতরণ অন্যতম, যেখানে শ্রী কৃষ্ণের প্রসাদ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা: ইসকন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। তারা সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা পালন করে এবং বিশেষ করে শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান সমাজ গঠনে কাজ করে।
আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান ও মন্দির স্থাপন
- ইসকন বিশ্বজুড়ে বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে ধর্মীয় উপাসনা এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেওয়া হয়। এসব মন্দির ভক্তদের জন্য আধ্যাত্মিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
- ইসকন তাদের মন্দিরগুলোতে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান ও উৎসব আয়োজন করে, যেমন রথযাত্রা, শ্রী কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ইত্যাদি, যাতে ভক্তরা শ্রী কৃষ্ণের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানাতে পারে।
সংস্কৃতির প্রচার
- ইসকন শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা নয়, বরং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও অংশ নেয়। তারা বিশেষভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং কৃষ্ণভক্তির আদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়।
- সংগঠনটি নৃত্য, গান, সংকীর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা এবং সংস্কৃতির ঐক্য প্রচার করে।
বৈশ্বিক সম্প্রসারণ
- ইসকন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এটি বর্তমানে প্রায় ১২০টি দেশে সক্রিয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মন্দির, সেবা কেন্দ্র ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনা করছে।
শেষ কথা:
ইসকন একটি ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক এবং সমাজসেবামূলক সংগঠন, যা শ্রী কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি ও সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে। এটি মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে, এবং এর শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ শান্তি, আনন্দ এবং পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। ইসকন শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পুরো বিশ্বে প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পৃথিবীজুড়ে মানুষের জীবন যাত্রা আরও আধ্যাত্মিক, শুদ্ধ এবং সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে।