ইসকন বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ISKCON) একটি বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ। এই সংগঠন মূলত হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনুসরণকারী এবং কৃষ্ণভক্তির প্রচারক। ইসকনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রী কৃষ্ণের পদে প্রেম ভক্তি স্থাপন করা এবং তার উপদেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করা।
ইসকনের ইতিহাস
ইসকনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কে, শ্রীল প্রভুপাদ দ্বারা। তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় ধর্মগুরু, যিনি পশ্চিমা বিশ্বে হিন্দু ধর্মের বাণী পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণভক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে প্রচার করেছিলেন এবং উপনিষদ, ভগবদ গীতা, শ্রীমদ্ভাগবতামের মতো হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর ভাষ্য প্রকাশ করেছিলেন। তার প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, ইসকন এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তৃত।
ইসকনের উদ্দেশ্য
ইসকনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রী কৃষ্ণের পূজা ও বন্দনা করে এক মহান ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করা। তারা বিশ্বাস করে যে, কৃষ্ণই স্রষ্টা এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ ভক্তি ও প্রেম প্রদর্শন করলেই মানুষ জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে। ইসকনের কর্মসূচি পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন মন্দির এবং কেন্দ্রের মাধ্যমে চলমান, যেখানে লোকেরা ধর্মীয় শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক চর্চা লাভ করতে পারে।
ইসকনের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড
ইসকনের সদস্যরা প্রতিদিন বিভিন্ন ধর্মীয় আচরণে লিপ্ত থাকে। তারা নিয়মিত ‘হরিনাম সংকীর্তন’ (কৃষ্ণের নাম জপ) করে, শ্রীরামচন্দ্র বা শ্রী কৃষ্ণের কীর্তন পরিবেশন করে। তারা ভগবদ গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবতামের পাঠ ও চর্চা করে থাকে। এছাড়া, ইসকন পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজেও নিয়োজিত থাকে, যেমন গরীবদের খাবার দেওয়া এবং শিক্ষার প্রসারে কাজ করা।
ইসকন এবং এর বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ
ইসকন পৃথিবীজুড়ে ১২০টিরও বেশি দেশে প্রতিষ্ঠিত। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা প্রদান করা এবং মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। তাদের কার্যক্রমে খাদ্য বিতরণ, ধর্মীয় শিক্ষা, এবং আধ্যাত্মিক চর্চা অন্তর্ভুক্ত। ইসকনের বিভিন্ন মন্দির বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ জনপ্রিয়।
ইসকন কোন কোন দেশে নিষিদ্ধ
যদিও ইসকন বিশ্বের অনেক দেশেই স্বীকৃত, তবে কিছু দেশে এটি নিষিদ্ধ বা সীমিত করা হয়েছে। এর কারণ হলো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, এবং ধর্মীয় কর্মকান্ড।
রাশিয়া:
রাশিয়ায় ১৯৯৭ সালের পর ইসকনের কার্যক্রম কিছুটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। রাশিয়ার সরকার ইসকনকে ‘একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়’ হিসেবে অনুমোদন দেয়নি। ২০১৯ সালে রাশিয়ার আদালত ইসকনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, কারণ তারা এটিকে একটি ‘বিরল ধর্মীয় সম্প্রদায়’ হিসেবে মনে করে এবং তারা বিশ্বাস করে যে এটি সমাজের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
চীন:
চীনেও ইসকন নিষিদ্ধ। চীন সরকার দেশের মধ্যে অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনগুলোর মতোই ইসকনকে নিষিদ্ধ করেছে। সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা সীমিত এবং বিদেশি ধর্মীয় কার্যক্রমে চীন সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
আরব বিশ্ব:
আরব দেশের কিছু অংশে, বিশেষত সৌদি আরবে, ইসকন নিষিদ্ধ। সৌদি আরবের সরকার হালাল (বিশ্বাসযোগ্য) ধর্মীয় প্রচারণা ছাড়া অন্য ধর্মীয় মতবাদগুলোকে স্বীকৃতি দেয় না। এর ফলে ইসকনের কার্যক্রম সেখানে অবৈধ হিসেবে গণ্য হয়।
পাকিস্তান:
পাকিস্তানে ইসকনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ সেখানে ইসলাম ধর্মের প্রচার বেশি। পাকিস্তানে হিন্দু ধর্মের কিছু অংশ রয়েছে, কিন্তু ইসকনের কার্যক্রম সেখানে ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ এবং সীমাবদ্ধ।
মালয়েশিয়ায়:
মালয়েশিয়ায়ও ইসকন নিষিদ্ধ। ইসকনের বিরুদ্ধে দেশটিতে প্রকাশ্যে ধর্মান্তর করণের অভিযোগ আছে।
এ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ায়, ইরানে, আফগানিস্তানে, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানে ইসকনের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি জারি রয়েছে। কিছু শর্ত মেনে দেশটিতে কার্যক্রম চালাতে পারে সংগঠনটি।
ইসকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ইসকন কখনো কখনো কিছু দেশে বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে এটি “একটি আধ্যাত্মিক আন্দোলন” হিসেবে পরিগণিত হলেও, কিছু মানুষ একে “সাধারণ ধর্মীয় ধর্মগুরুদের মতো একটা প্রচারমূলক প্রতিষ্ঠান” হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। তাদের মতে, ইসকন একটি “আঞ্চলিক ধর্মীয় সম্প্রদায়” যা কিছু সদস্যদের জন্য আধ্যাত্মিক বাণী ছড়িয়ে দেয়, তবে তাদের কর্মসূচি অনেক সময় সন্দেহজনক মনে হতে পারে। তাদের শিক্ষার কিছু অংশই কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শেষকথা
ইসকন একটি ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক সম্প্রদায়, যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে আসছে। যদিও ইসকন বেশিরভাগ দেশেই অনুমোদিত, কিছু দেশ তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে, মূলত রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে। ইসকনের সদস্যরা বিশ্বাস করে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রী কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি এবং প্রেমের মাধ্যমে জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করা।
এখনও, ইসকন পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার অনুসারী এবং ভক্তদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে, তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে আরো উন্নত করার জন্য।