আবহাওয়া ও জলবায়ু কি? পার্থক্য, কারণ ও প্রভাব

আবহাওয়া ও জলবায়ু

আবহাওয়া কি?

আবহাওয়া বলতে মূলত কোনো স্থানের স্বল্প সময়ের বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থাকে ঝোঝায়। সাধারণত এক দিনের এমন রেকর্ডকেই আবহাওয়া বলা হয়।

কোনো নির্দিষ্ট স্থানের বায়ুর উষ্ণতা, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুচাপ, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা প্রভৃতি উপাদানের দৈনন্দিন অবস্থাই আবহাওয়া। স্থানভেদে খুব সহজেই আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়। কোনো স্থানের আবহাওয়া প্রতি ঘণ্টায় বা প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়। আমরা যে আবহম-লে বসবাস করি, তার মধ্যে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকমের আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে সৃষ্টি হয় বার্ষিক গতি, আহ্নিক গতি, মেঘ, ঝড়, বৃষ্টি, তুফান ও ভূমিকম্প। পৃথিবীর এই পরিবর্তন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

জলবায়ু কি?

জলবায়ু হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানের দীর্ঘ সময়ের (সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর) আবহাওয়ার বিভিন্ন অবস্থার গড় অবস্থাকে বোঝায়।

মূলত এটি কোনো স্থানের দীর্ঘ দিনের বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, তাপমাত্রা, রৌদ্রালোক ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। প্রাকৃতিক ভাবে পৃথিবীর সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান, সৌর বিকিরণের মাত্রা, বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, অক্ষরেখার দিক পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে জলবায়ু স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হতে পারে।

আবহাওয়া ও জলবায়ু মধ্যে পার্থক্য

আমরা অনেকেই আবহাওয়া আর জলবায়ুকে এক মনে করি। কিন্তু না এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আজকে আমরা সেই বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুনতাহলে যেনে নেওয়া যাক আবহাওয়া ও জলবায়ু মধ্যে পার্থক্য সমূহ-

  1. আবহাওয়া হল জলবায়ুর বিভিন্নতা। আর জলবায়ু হল বিভিন্ন আবহাওয়ার সমন্বয়।
  2. আবহাওয়া স্থানভেদে সহজেই পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে জলবায়ু স্থান ও ঋতুভেদে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়।
  3. আবহাওয়া হল বায়ুমণ্ডলের নিম্ন স্তরের নিত্য দিনের অবস্থা। আর জলবায়ু হল বায়ু মণ্ডলের নিম্ন স্তরের দীর্ঘ কালীন সামগ্রিক অবস্থা।
  4. কোনো নির্দিষ্ট স্থানের নির্দিষ্ট সময়ের বায়ুচাপ, বায়ুর উষ্ণতা, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, আদ্রতা প্রভৃতি উপাদানের দৈনন্দিন অবস্থাকে আবহাওয়া বলা হয়। আর কোনো প্রসারিত অঞ্চলের কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে জলবায়ু বলা হয়।
  5. কোনো স্থানের আবহাওয়া প্রতিদিন এমনকি প্রতি ঘন্টায়ও পরিবর্তিত হতে পারে। এদিকে জলবায়ু প্রতি দিনের ব্যবধানে কোনো অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তিত হয় না।
  6. আবহাওয়া স্বল্প পরিসরে সীমাবদ্ধ কোনো স্থানের বায়ু মণ্ডলের সাময়িক অবস্থাকে সূচিত করে। অন্যদিকে জলবায়ু একটি বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলের বায়ু মণ্ডলের দীর্ঘ কালীন গড় অবস্থাকে নির্দেশ করে।

আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণ

আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো বায়ুপ্রবাহ বা বায়ুমণ্ডলীয়।

বায়ুপ্রবাহ বা বায়ুমণ্ডলীয় সঞ্চালন বলতে বিরাট একটি ক্ষেত্র জুড়ে বায়ুর স্থান পরিবর্তনকে বোঝায়। বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমেই পৃথিবী পৃষ্ঠে উত্তাপের বন্টন ঘটে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিবেচনায়, "সূর্যের তাপ" পৃথিবীতে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে পড়ে। ফলে কোনো স্থান যখন সরাসরি ভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠে, তখন তুলনামূলক ভাবে শীতল স্থানের দিকে উত্তপ্ত বায়ু প্রবাহিত হয়। বায়ুর মূল ধর্মই হলো অধিক উষ্ণ স্থান থেকে শীতল স্থানের দিকে বায়ু প্রবাহিত হবে। মূলত এই সব কারণেই পৃথিবীতে বায়ুপ্রবাহের ঘটনা ঘটে। এই বায়ুপ্রবাহ যখন সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তাকে দখিনা হাওয়া বলা হয় যা জনজীবনে সুখকর অনুভূতি বয়ে আনে। আবার যখন এই বায়ুপ্রবাহ মাত্রা অতিরিক্ত হয়, তখন তা জলভাগে জলোচ্ছ্বাস এবং স্থলভাগে ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে। মূলত উচ্চ-চাপীয় অঞ্চল থেকে নিম্ন-চাপীয় অঞ্চলে বায়ু প্রবাহিত হয়ে থাকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ

মূলত কোনো স্থান বা জায়গার দীর্ঘদিনের বায়ুপ্রবাহ, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, রৌদ্রালোক ইত্যাদির উল্লেখ যোগ্য পরিবর্তনকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে নির্দেশ করা হয়। প্রাকৃতিক ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, অক্ষরেখার দিক পরিবর্তন, সৌর বিকিরণের মাত্রা, সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান ইত্যাদির কারণে জলবায়ু স্বাভাবিক ভাবেই পরিবর্তন হয়। তবে মানবসৃষ্ট কলকারখানা, কয়লা পোড়ানো, যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস, ইটভাটার ধোঁয়া, গাছ কাটা ইত্যাদি কারণেই জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।

এছাড়াও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বাড়ছে। বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াই তাপমাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মানবসৃষ্ট এই গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণয়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ মনে করা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কারণ রয়েছে। প্রতি বছরই ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি খরায় আক্রান্ত হচ্ছে। আকস্মিক বন্যায় হাজার হাজার একর জমির পাকা ধান নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়। ধান গাছের কচি থোড় থেকে ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হলে ধান চিটা হয়ে যায়। এছাড়াও অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও তাপের কারণে গাছের ছত্রাক রোগ বেড়ে যায়। এমনকি পোকামাকড়ের আক্রমনও বেড়ে যায়। কম বৃষ্টি পাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এটা সত্য যে, বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকরা ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য হুমকি স্বরূপ। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সারাবিশ্বে ব্যাপক ভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। এর প্রভাবে বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।

বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্ষয়-ক্ষতির কারণে আগামী দশক গুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে সংঘাত বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি, ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল- যা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দশক গুলোতে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে থাকা মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url