ধান উৎপাদনে বোরো মৌসুম বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়। এই ধান থেকে প্রতিবছর ১৫.৫ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন হয়। উফশী বোরো ধানের চাষ করা হয় ৩.৯ মিলিয়ন হেক্টরে। মাঠ পর্যায়ে উফশী বোরো ধানের গড় ফলন ৫ টন প্রতি হেক্টরে এবং ৪.০ থেকে ৮.৫ টন প্রতি হেক্টর পর্যন্ত পাওয়া যায়। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.০ টন বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য হলো ধান। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। এদেশে ধানের হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪.২ টন। জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে দেশের ধান উৎপাদনের তিনটি মৌসুম লক্ষ্য করা যায়। যথা- আউশ, আমন ও বোরো। “বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট” কর্তৃক বোরো ধানের প্রায় ২৭টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জাতগুলোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য সমূহ ও চাষ পদ্ধতি দিচে তুলে ধরা হলো।
বোরো ধানের বৈশিষ্ট্য
নতুন চষীদের মধ্যে অনেকেই বোরো ধানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। ফলে তারা এই ধানের বৈশিষ্ট্য জানতে চান। তাদের বোঝার সুবিধার্থে নিচে বোরো ধানের বৈশিষ্ট্য গুলো তুলে ধরা হলো-
- গাছের গড় উচ্চতা ৯৫ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার।
- কাণ্ড খুব মজবুত যে কারণে গাছ হেলে পড়ে না।
- জাতটির জীবনকাল ১৫৫ থেকে ১৭০ দিন পর্যান্ত।
- হেক্টরপ্রতি ফলন গড়ে ৬.০ থেকে ৬.৫ টন।
- এর চাল মাঝারি মোটা ও সাদা হয়।
- ভাত খুব সুন্দর ঝরঝরে হয়।
বোরো ধান চাষ পদ্ধতি
বোরো মৌসুমে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়। এই ধান থেকে প্রতিবছর ১৫.৫ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন হয়। কিন্তু অনেকেই বোরো মৌসুমে কিভাবে ধান চাষ করবেন বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য বোরো ধান চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো-
- জাত নির্বাচন: বোরো মৌসুমের ধানের জাতগুলোতে আলোক সংবেদনশীলতা নেই। মৌসুম শুরু হয় শীতকালে আর ফুল আসে গরমের শুরুতে। আলোক সংবেদনশীল কোনো জাত বোরো মৌসুমে চাষ করা যাবে না।
- জীবনকাল অনুসারে বোরো মৌসুমের জাত গুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। দীর্ঘ মেয়াদি (১৫০ দিনের বেশি জীবনকাল) আর স্বল্প মেয়াদি (১৫০ দিনের কম জীবনকাল)।
- দীর্ঘ মেয়াদি জাত হলো: বিআর ১৪, বিআর ১৬, ব্রি ধান ২৯, ব্রি ধান ৫৮, ব্রি ধান ৫৯ ও ব্রি ধান ৬০ ইত্যাদি।
- স্বল্প মেয়াদি জাত হলো: ব্রি ধান ২৮, ব্রি ধান ৪৫, ব্রি ধান ৫৫, ব্রি ধান ৭৪, ব্রি ধান ৮১, ব্রি হাইব্রিড ধান ২, ব্রি হাইব্রিড ধান ৩, ব্রি হাইব্রিড ধান ৫ ইত্যাদি।
- বীজ বপন: যে জাত গুলোর জীবন কাল ১৫০ দিনের বেশি সেগুলোর বীজ ১ই নভেম্বর থেকে বীজ তলায় বপন শুরু করতে হবে।
- যেসব জাতের জীবন কাল ১৫০ দিনের কম সেগুলোর বীজ ১৫ নভেম্বরের পর থেকে বপন করতে হবে।
- চারা রোপণের সময়: চারা রোপণ উপযুক্ত সময় হলো ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি।
- চারার বয়স: ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সী চারা রোপণ করা উচিত।
- রোপণ দূরত্ব: সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০ সেমি (৮ ইঞ্চি) এবং গুছি থেকে গুছির দূরত্ব হবে ২০ সেমি (৮ ইঞ্চি)।
- সার ব্যবস্থাপনা: আবহাওয়া ও ধানের জমির মাটির উর্বরতার মান যাচাই করাসহ ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করতে হবে।
- দীর্ঘ মেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে: ইউরিয়া- ৪০ কেজি, ডিএপি/টিএসপি- ১৩ কেজি, এমওপি- ২২ কেজি, জিপসাম- ১৫ কেজি ও দস্তা (মনোহাইড্রেট)- ১.৫ কেজি বিঘা প্রতি প্রয়োগ করতে হবে।
- জমি তৈরির শেষ চাষের সময় সমস্ত ডিএপি/টিএসপি, জিপসাম, দস্তা ও অর্ধেক এমওপি প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া সমান তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করে দিতে হবে। প্রথম কিস্তি চারা রোপন করার ১৫ থেকে ২০ দিন পর, দ্বিতীয় কিস্তি গুছিতে কুশি দেখা দিলে বা প্রথম কিস্তির ২০ থেকে ২৫ দিন পর এবং তৃতীয় কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫ থেকে ৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। বাকী অর্ধেক এমওপি তৃতীয় কিস্তি ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
- স্বল্প মেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে: বিঘা প্রতি ইউরিয়া- ৩৫ কেজি, ডিএপি/টিএসপি- ১২ কেজি, এমওপি- ২০ কেজি, জিপসাম- ১৫ কেজি ও দস্তা (মনোহাইড্রেট)- ১.৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
- এক্ষেত্রে জমি চাষের শেষ পর্যায়ে সমস্ত টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া সমান তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করে দিতে হবে। প্রথম কিস্তি চারা রোপন করার ১৫ থেকে ২০ দিন পর, দ্বিতীয় কিস্তি চারা রোপনের ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর এবং তৃতীয় কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫ থেকে ৭ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
- নোট: ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘা প্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া সার কম লাগে।
- আগাছা দমন: চারা রোপণ করার পর ৪৫ থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
- সেচ ব্যবহার: চারা রোপনের পর থেকে থোরের ধান আংশিক শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- রোগবালাই বা পোকামাকড়:
- বোরো মৌসুমে ধানের প্রধান রোগবালাই হলো-
- নেক ব্লাস্ট
- ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া
- বাকানি
- চারাপোড়া বা ঝলসানো
- বোরো মৌসুমে ধানের প্রধান পোকামাকড় হলো-
- থ্রিপস
- বাদামী গাছ ফড়িং
- পাতা মোড়ানো পোকা
- মাজরা পোকা
- উপরের উল্লেখিত বা যে কোন ধরনের রোগবালাই বা পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
- ফসল কাটা: বৈশাখ মাস থেকে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত ফসল কাটার উপযুক্ত সময়।
বোরো ধান কোন ঋতুতে হয়
বোরো ধান হেমন্তকালে চাষ করা হয়। হেমন্তকালের শুরু থেকে গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ধানের জীবনকাল চলে। তবে এই ধানের মূল ফলন বসন্তকালে হয় বলে একে বাসন্তিক ধান বলা হয়।
বোরো ধান লাগানোর সময়
আমন ধানের মৌসুম শেষ হবার পরে বোরো ধানের মৌসুম শুরু হয়। ধান রোপণ করা শুরু হয় বাংলার কার্তিক (অক্টোবর থেকে নভেম্বর) মাস থেকে এবং ধান পাকে বাংলার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-জুন) মাস পর্যন্ত।
উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের জাত সমূহ
বোরো মৌসুমে ধানের প্রায় ২৫টি জাত রয়েছে। অনেকেই বোরো ধানের কি কি জাত রয়েছে তা জানেন না বিশেষ করে নতুন কৃষকেরা জানেন না। তাই তাদের সুবিধার্থে উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের জাত সমূহ নিচে তুলে ধরা হলো-
- বিআর ৩
- ব্রিআর ১৪
- ব্রিআর ১৬
- ব্রিআর ১৭
- ব্রিআর ১৮
- ব্রিআর ১৯
- ব্রিআর ২৮
- ব্রিআর ২৯
- ব্রিআর ৩৬
- ব্রিআর ৪৫
- ব্রিআর ৪৭
- ব্রিআর ৫০
- ব্রিআর ৫৫
- ব্রিআর ৫৮
- ব্রিআর ৫৯
- ব্রিআর ৬০
- ব্রিআর ৬১
- ব্রিআর ৬৩
- ব্রিআর ৬৪
- ব্রি হাইব্রিড ধান ১
- ব্রি হাইব্রিড ধান ২
- ব্রি হাইব্রিড ধান ৩
বোরো ধানের সর্বশেষ আধুনিক জাত
- ব্রি ধান ৬৭
- ব্রি ধান ৬৮
- ব্রি ধান ৬৯