বিন্দু মরিচ এর বৈশিষ্ট্য, চাষ পদ্ধতি, পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

বিন্দু মরিচ চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল হলো মরিচ। এটি নিত্য ব্যবহৃত একটি মশলা। বাংলাদেশের সব জায়গায়ই কম বেশি মরিচের চাষ হয়ে থাকে। মরিচ শুধুমাত্র মশলা বা রসনা তৃপ্তিতে ব্যবহার হয় না। নিয়মিত পরিমিত কাচা মরিচ খেলে এর থেকে ভিটামিন এ, বি, সি-এর পাওয়া যায়।

বিন্দু মরিচের বৈশিষ্ট্য

বর্তমানে চাষীদের কাছে খুবি জনপ্রিয় একটি মরিচ হলো বিন্দু মরিচ। ঝালের কারণে এই মরিচটি মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত। নিচে বিন্দু মরিচের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-

  1. কাঁচা বিন্দু মরিচ উজ্জ্বল সবুজ রঙের হয়।
  2. এই জাতের মরিচ খেতে খুব বেশী ঝাল হয়।
  3. এক একটি বিন্দু মরিচ গড়ে ২.৫ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা হয়।
  4. চারা রোপন করার ৫০ দিন পর থেকে মরিচ তোলা যায়।
  5. প্রতিটি মরিচের গড় ওজন ৩ থেকে ৪ গ্রাম।
  6. বিন্দু মরিচ একটানা দীর্ঘদিন যাবৎ ফলন দিতে থাকে।
  7. গাছ লম্বায় অনেক বড় হয় এবং এটি একটি বারোমাসি জাত।
  8. এটি মূলত শুকনা মরিচের জন্য উত্তম।

বিন্দু মরিচ চাষ পদ্ধতি

বিন্দু মরিচ চাষ করার জন্য আলাদা কোনো নিয়ম নেই। অন্যান্য উন্নত জাতের মরিচ যেভাবে চাষ করা হয় সেভাবেই চাষ করতে পারেন। নিচে বিন্দু মরিচ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

  1. উপযুক্ত জমি ও মাটি নির্বাচন: প্রচুর আলো বাতাস রয়েছে এবং পানি সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা রয়েছে এমন দো-আঁশ মাটি বিন্দু মরিচ চাষ করার জন্য উপযুক্ত।
  2. বীজতলা প্রস্তুত: জমি ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে আগাছা বাছাই করে ৩x১ মিটার আকারের বীজতলা তৈরি করে সেখানে বীজ বপন করতে হবে।
  3. বীজ বপন: শীতকালের জন্য ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং বর্ষা মৌসুমের জন্য ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। চারা ১০ সেন্টিমিটার উঁচু হলে চারা রোপণের উপযোগী হয়।
  4. চারা রোপণ: আগাছা পরিষ্কার করে ৪ থেকে ৫ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি প্রস্তত করে চারা রোপণ করতে হবে। চারা সব সময় বিকেলে লাগাতে হয় এবং লাগানোর পর ২ থেকে ৩ দিন সকাল বিকাল পানি দিতে হবে।
  5. দূরত্ব: সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার।
  6. সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি হেক্টর জমিতে গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি ও এমওপি ১৫০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
    • জমি তৈরি করার সময় সমস্ত গোবর, টিএসপি ‌এবং ৫০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
    • চারা রোপণ করার ২৫ দিন পর ৮৪ কেজি ইউরিয়া ও ৩৪ কেজি এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
    • চারা রোপণ করার ৫০ দিন পর ৮৩ কেজি ইউরিয়া ও ৩৩ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
    • চারা রোপণ করার ৭০ দিন পর ৮৩ কেজি ইউরিয়া ও ৩৩ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
  7. সেচ ব্যবস্থা: গ্রীষ্মকালে ৪ থেকে ৫ দিন পর পর এবং শীতকালে ১০ থেকে ১২ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। তাছাড়াও প্রতি বার সার প্রয়োগ করার পর সেচ দিতে হবে। সেচের পরে যদি মাটিতে চটা দেখা দেয় তাহলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে, এতে করে শিকড় প্রয়োজনীয় আলো বাতাস পাবে এবং গাছের বৃদ্ধি বেশি হবে।
  8. আগাছা দমন: জমিতে আগাছা দেখা দিলে সাথে সাথে তা পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়াও সার উপরি প্রয়োগ করার সময় কোদাল দিয়ে মটি কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে।
  9. লক্ষ্যণীয়: ফুল আসার সময় এবং তার ২০ থেকে ৩০ দিন পর অনুমোদিত হরমোন জাতীয় ওষুধ ১০ থেকে ১২ লিটার পানিতে ২ মিলি হারে দ্রবন তৈরি করে গাছে প্রয়োগ করতে হবে। এতে করে মরিচ অকালে ঝরে পড়বে না এবং ফলন হবে দ্বিগুন।
  10. রোগবালাই বা পোকামাকড়: বিন্দু মরিচের রোগ বালাই কম হয়। তার পড়েও যদি কোন প্রকার রোগবালাই বা পোকামাকড় আক্রমন দেখা দেয় তাহলে দেরি না করে প্রজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

কাঁচা মরিচের পুষ্টিগুণ

কাঁচা মরিচে ক্যাপসাইকিন থাকে, যা মূলত মরিচকে ঝাল করতে সাহায্য করে। প্রতিটি কাঁচা মরিচে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, কে, বি৬, রিবোফ্লাবিন, থিয়ামিন, নিয়াসিন, ফোলেট, আয়রন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার ইত্যাদি খনিজ উপাদান। এছাড়াও প্রচুর পরিমান ডায়াটারি ফাইবার, অল্প পরিমাণে কার্বহাইড্রেট, পানি ও প্রোটিন রয়েছে।

বিন্দু মরিচের উপকারিতা

বিন্দু মরিচ বা যে কোন কাঁচা মরিচ খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। নিচে বিন্দু মরিচের উপকারিতা সমূহ তুলে ধরা হলো-

  1. মরিচে থাকা ভিটামিন সি চুল ও মাড়িকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
  2. মরিচে থাকা ভিটামিন-এ দাঁত, হাড় ও মিউকাস মেমব্রেনকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।
  3. নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেলে দেহের মেটাবলিজম বাড়িয়ে ক্যালোরি পোড়াতে সাহায্য করে।
  4. কাঁচা মরিচে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকে বলিরেখা পড়তে দেয় না। ফলে ত্বক ও চুল উজ্জ্বল থাকে।
  5. কাঁচা মরিচে থাকা বিভিন্ন উপাদান শরীরের প্রদাহ দূর করতে সাহায্য করে এবং আলসারের মত সমস্যাকে দূরে রাখতে সহায়তা করে।
  6. বিটা ক্যারোটিন ও ভিটামিন রয়েছে কাচা মরিচে। যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
  7. কাঁচা মরিচ খাওয়ার সাথে সাথে শরীরের এন্ডোরফিন নামক হরমোনের ক্ষরণ হতে থাকে। এই হরমোন ক্ষরণ হওয়ার ফলে স্ট্রেস কমতে শুরু করে। ফলে মন মেজাজ সতেজ থাকে।
  8. কাঁচা মরিচে থাকা বিভিন্ন পুষ্টিগুন রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। যে কারণে রক্ত জমাট বাধার ঝুঁকি কমায় এবং ফলে হার্টের সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায়।
  9. যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে তারা নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেতে পারেন উপকার পাবেন। কারণ কাচা মরিচ ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
  10. কাঁচা মরিচ ডায়েটারি ফাইবার সমৃদ্ধ একটি ফল হজম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য খুবই উপকারী। নিয়মিত কাচা মরিচ খেলে স্যালাইভার উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে অম্বল, গ্যাস ও বদহজমের মতো সমস্যা দূর হয়।
  11. কাঁচা মরিচে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি যা শরীরকে জ্বর, কাশি ও সর্দি থেকে রক্ষা করে। শীতের মৌসুমে ঠান্ডার সমস্যায় বা সাইনাসের সমস্যা প্রতিরোধে কাঁচা মরিচ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
  12. কাঁচা মরিচে থাকা ক্যাপসাইকিন খাবারে থাকা উচ্চমাত্রার চর্বিকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। চর্বি জাতীয় খাবারের সথে নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেলে শরীরে মেদ জমতে পারে না। এছাড়াও নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেলে শরীরে জমে থাকা ফ্যাট আস্তে আস্তে গলতে শুরু করে।

নোট: কাঁচা মরিচ আমরা কাঁচা অবস্থায় খায়, আবার রান্না করেও খাই। কিন্তু রান্না করে খেলে মরিচের পুষ্টিগুণ কিছুটা কমে যায়। তবে কাঁচা অবস্থায় খেলে কিছু কিছু ভিটামিন একদম সরাসরি পাওয়া যায় এবং উপকারিতাও বেশি।

প্রতিদিন কাঁচামরিচ কী পরিমাণ খাবেন তা নির্ভর করে ব্যক্তির নিজের উপর। কেননা কেউ ঝাল বেশি খেতে পছন্দ করে আবার কেউ কম খেতে পছন্দ করে। কেউ কেউ তো শুধু ঘ্রাণের জন্য পছন্দ করেন। দিনে একটি কাঁচামরিচ খেলেও উপকার পাবেন, রুচিবর্ধক হিসেবে কাজ করবে।

তবে বেশি ঝাল খাওয়া একদম ঠিক হবে না। ঝাল খাওয়ার সময় আবশ্যয় খাদ্যনালীর কথা মাথায় রাখতে হবে। বেশি ঝাল খেলে মুখে যেমন ঝাল অনুভূত হয় ঠিক তেমনি খাদ্য নালীতেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই যত উপকারিতাই থাকুক না কেনো বেশি পরিমাণে খাওয়া ঠিক হবে না। নিয়মিত পরিমিত মাত্রায় খাওয়া উত্তম হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url