কৃষি আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য ও তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প

কৃষি আবহাওয়া

কৃষি আবহাওয়া সংক্রান্ত কার্যক্রম বাংলাদেশে খুব সীমিত। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশব্যাপী ১২টি কৃষি আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। যেখানে কৃষি আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগৃহীত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর কৃষি কাজের সুবিধার্থে তিন ধরনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানের কাজ করে থাকে।

  1. অল্পপরিসরের পূর্বাভাস (৪৮ ঘণ্টা)
  2. মধ্যমমাত্রার পূর্বাভাস (১০ দিন)
  3. দীর্ঘসময়ের পূর্বাভাস (১০ দিনের অধিক)।

ফলে দেশব্যাপী সকল কৃষক আগে থেকেই খবরা খরব পেয়ে যাচ্ছে এবং সঠিক সময় সঠিক কাজ করতে পারছেন। এতে করে যেমন কৃষকেরা লাভবান হচ্ছে ঠিক তেমনি দেশ ও উন্নত হচ্ছে।

কৃষি আবহাওয়া কাকে বলে ?

কৃষি আবহাওয়া হলো কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত আবহাওয়া বিজ্ঞানের বিশেষ এক শাখা। আবহাওয়া, বায়ুমন্ডল ও জলবায়ুসহ এর দৃশ্যমান বিষয়াবলি সম্পর্কে কৃষি আবহাওয়া বিজ্ঞান আলোচনা করে।

জলবায়ু ও স্থানীয় আবহাওয়া নিয়ে কৃষি আবহাওয়া ব্যাপকভাবে আলোচনা করে। সাধারণভাবে বলতে গেলে, আবহাওয়া বায়ুমন্ডলের তাৎক্ষণিক অবস্থা, বিকিরণ, বায়ুর চাপ, তাপমাত্রা, প্রবহমান বায়ু, মেঘাচ্ছন্নতা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, শিশির, বাষ্পীভবন এবং দৃষ্টিগোচরতা সম্পর্কে তথ্যের যোগান দেয়।

কৃষি আবহাওয়া অধিদপ্তর জমির ব্যবহারকে উন্নত করা, অধিক পরিমাণে খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করা এবং ভূমিসম্পদের অপব্যবহার রোধ করাসহ কৃষিকাজের সব দিকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খামার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ, গবাদি পশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিশ্চিতকরণে, ফসল এবং উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ উন্নয়নে কৃষি আবহাওয়া কাজ করে থাকে।

কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আক্রান্ত একটি দেশ। প্রতিবছরই বিভিন্ন দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। বাংলাদেশ দুর্যোগপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু, আবহাওয়া, নদ-নদীর পানির অবস্থা, আগাম সতর্কীকরণ সম্পর্কিত তথ্যাদি কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশ অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ বিষয়ে কারিগরি দিক থেকে উন্নত মানের নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। টেকসই কৃষি উৎপাদনের জন্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের কাছে তাঁদের উপযোগী ভাষায় সরবরাহ করা তাদের একমাত্র লক্ষ্য।

২০১২ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা "বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি কারিগরি সেমিনারের আয়োজন করেছিল"। উক্ত সেমিনারে অংশগ্রহনকারী দেশী ও বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশের "কৃষি আবহাওয়ার" সেবার মান তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকরভাবে বৃদ্ধির জন্য তিনটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছিলেন-

  1. কৃষিবিদদ ও আবহাওয়াবিদের সমন্বয়ে "কৃষি আবহাওয়া" পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি মৌসুমীর পূর্বাভাস, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস ও পরামর্শ সেবার মান বৃদ্ধি করা।
  2. কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ ও পূর্বাভাস সংক্রান্ত সেবা তৃণমূল পর্যায়ে নিয়মিত ও দ্রুত গতিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য একটি দ্রুত ও কার্যকর যোগাযোগ ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
  3. কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ ও পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্যবলি তৃণমূল পর্যায়ে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সঠিক সাড়া প্রদান ব্যবস্থার চালুকরণ।

উপরের উল্লেখিত তিনটি ক্ষেত্র বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় "বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর" এর সমন্বয়ে "Bangladesh Weather and Climate Services Regional Project" বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদিত করেন। সংস্থা তিনটি পৃথক পৃথক ডিপিপি এর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে করেছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন "কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর" (ডিএই) কম্পোনেন্ট-সি “কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প (Agro-Meteorological Information Systems Development Project)” বাস্তবায়ন করেছেন।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য:

প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো আবহাওয়া ও নদ-নদীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কিত উন্নত মানের নির্ভরযোগ্য তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানো এবং এ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহারে ডিএই’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ:

প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। নিচে প্রকল্পের সেই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরা হলো-

  1. কৃষি উৎপাদন টেকসই করার লক্ষ্যে কৃষকের কাছে কৃষি আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং জলবায়ু ও আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাবসমূহের সাথে কৃষকদের খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
  2. বৈজ্ঞানিক ভাবে স্বীকৃত কৃষি আবহাওয়ার তথ্য পদ্ধতি প্রচলন করা এবং যথোপযুক্ত তথ্য ও ডাটা সংগ্রহ করে কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া।
  3. কৃষি ক্ষেত্রে আবহাওয়া সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য কৃষি আবহাওয়া এবং নদ-নদীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কিত তথ্যাদি কৃষকের উপযোগী ভাষায় বিভিন্ন সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
  4. কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণের মাধ্যমে ডিএই’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম:

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হলো কম্পোনেন্ট-সি। যার তিনটি সাব-কম্পোনেন্ট রয়েছে। নিচে সাব- কম্পোনেন্টের নাম ও কাজ তুলে ধরা হলো-

  1. সাব-কম্পোনেন্ট সি-১: বামিস (BAMIS-Bangladesh Agro-Meteorological Information System) পোর্টাল স্থাপন করা।
  2. সাব-কম্পোনেন্ট সি-২: প্রশিক্ষণ, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বাস্তবায়ন করা।
  3. সাব-কম্পোনেন্ট সি-৩: নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ প্রস্ত্ততকরণ এবং তা বিভিন্ন সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

প্রকল্পের উপকারিতা:

কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ সেবা সহজলভ্য করেছে। খামার ব্যবস্থাপনায় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তার জন্য কৃষক পর্যায়ে সরাসরি পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি কৃষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও এ সম্পর্কিত পরামর্শ গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা রয়েছে ফলে কৃষকেরা ঘরে বসেই সব খবরা খবর পেয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় কৃষক পর্যায়ে নিয়মিত ভাবে যথাযথ খামার ব্যবস্থাপনা তথা শস্য পর্যায়, সেচ ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা প্রদান করে থাকে। বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপের জন্য আদর্শ সময় সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনায় আগাম সতর্কবার্তা প্রদানসহ ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে আন্ত: পরিচর্যা বা কৃষি উপকরণ ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য কৃষকদের সঠিক পরামর্শ প্রদান করা হয়। প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম কৃষকদেরকে আর্থিক ভাবে লাভবান করেছেন। এছাড়াও সামাজিক উন্নয়ন, কৃষির উন্নয়ন সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url