লিভার সিরোসিস কি, এর প্রাথমিক লক্ষণ ও মুক্তির উপায়
লিভার সিরোসিস অনিরাময়যোগ্য মারাত্মক একটি রোগ। লিভারে বিভিন্ন ধরনের রোগের মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ের রোগ হিসেবে লিভার সিরোসিসকে গন্য করা হয়। লিভার প্রতিস্থাপন বা ট্রান্সলেট ছাড়া লিভার সিরোসিস রোগ একেবারে নিরাময় করা সম্ভব নয়। এই জন্য লিভার সিরোসিসের রোগীরা ডাক্তারের কাছে গেলে তার চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ বেশি দেন।
বাংলাদেশের কত জন মানুষ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত আছে তার সঠিক পরিসংখ্যন নেই। তবে হেপাটাইটিস বি ও সি রোগে আক্রান্ত আছে প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ। এই হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষের লিভার সিরোসিস সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।
লিভার সিরোসিস মানে কি ?
একটি অপরিবর্তনীয় গুরুতর ব্যাধি হলো লিভার সিরোসিস, যা সুস্থ লিভারের টিস্যুকে দাগের টিস্যু দিয়ে প্রতিস্থাপন করে থাকে।
দীর্ঘদিন ধরে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত থাকার ফলে লিভারের কার্যকারিতা সংকোচিত হয় এবং আস্তে আস্তে কার্যক্রমে বাধাপ্রাপ্ত পায়, যাকে লিভার সিরোসিস বলা হয়।
লিভার সিরোসিস কেন হয় ?
অনেক কারণেই লিভার সিরোসিস হতে পারে। তবে লিভার বড় হয়ে যাওয়া বা লিভারে চর্বি জমার কারণে বেশির ভাগ সময়ে লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে।
দীর্ঘদিন ধরে লিভারে চর্বি জমতে জমতে এক পর্যায়ে লিভারের কার্যকারিতা কমে যায় এবং পরে তা লিভার সিরোসিস রূপে ধরা দিয়ে থাকে।
নিচে সেসব কারণে লিভারে চর্বি জমে বা দাগ পড়ে তা তুলে ধরা হলো-
- পিত্তথলির ব্যাধি
- বংশগত লিভারের রোগ
- অটোইমিউন হেপাটাইটিস
- দীর্ঘস্থায়ী অ্যালকোহল গ্রহণ
- ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ও সি
- নিয়মিত অতিরিক্ত ফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহন
লিভার সিরোসিস লক্ষণ:
লিভার সিরোসিস মানুষের শরীরে থাবা বসালে কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। নিচে লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক লক্ষণ সমূহ তুলে ধরা হলো-
- পা ফোলা
- রক্ত বমি হওয়া
- পেটে তরল জমা
- ওজন কমে যাওয়া
- ত্বকে কালশিটে পড়া
- অবসাদ দেখা দেওয়া
- কালো রঙের মল যাওয়া
- বমি বা বমি বমি ভাব হওয়া
- চোখ এবং ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া
- পেটে ব্যথা হওয়া এবং পেট ফোলা
- খাবারে অরুচি দেখা দেওয়া বা ক্ষুধামন্দা
- শারীরিক দুর্বলতা ও অস্থিরতা দেখা দেওয়া
উপরের উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তা না হলে লিভার ক্যান্সার, লিভার ফেইলিউর এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
লিভার সিরোসিস থেকে মুক্তির উপায়:
কিছু নিয়ম কানুন মেনে চললে লিভার সিরোসিস থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। নিচে লিভার সিরোসিস প্রতিরোধ বা মুক্তির উপায় তুলে ধরা হলো-
- লিভার সিরোসিস থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই মদ গ্রহণের অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিয়ে দিতে হবে।
- স্থূলতা (স্থূলতা বলতে সাধারণত শরীরের চর্বি জমে যাওয়াকে বুঝায়) এড়াতে নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে।
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন প্রকার পেইন কিলার গ্রহণ করা যাবে না। কারণ অতিরিক্ত পেইন কিলার লিভারের ক্ষতি করে থাকে।
- হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা নেওয়া না থাকলে দ্রুত টিকা গ্রহণ করতে হবে। শিশুর জন্মের পরেই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা দিতে হবে।
- হেপাটাইটিস সি ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে এবং অন্যের ব্যবহৃত ব্লেড বা রেজার ব্যবহৃর করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে কোমল পানীয়, ফাস্ট ফুড এবং বাইরের খোলা খাবার।
- কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
লিভার সিরোসিস রোগীর খাবার তালিকা:
লিভার সিরোসিস রোগীর খাবার নিয়ে অনেক সচেতন হতে হবে। কেননা লিভারের সমস্যা দেখা দিলে শরীরের হজম প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। তাই লিভার সিরোসিস রোগীদের কি খাবার খেলে হজম প্রক্রিয়ায় কোন সমস্যা হবে না তা যানা প্রয়োজন। নিচে লিভার সিরোসিস রোগীর খাবার তালিকায় কি কি খাবার রাখবেন আর কি কি খাবার বাদ দিবেন তা তুলে ধরা হলো-
লিভার সিরোসিস রোগীর খাবার তালিকায় যে খাবার গুলো রাখবেন তা হলো-
- প্রতিদিন ৪ থেকে ৬ টি ডিম কুসুম সহ খেতে পারেন।
- সালাদ ও প্রোবায়োটিক খাবার বা আচার খেতে পারবেন।
- প্রেটিন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে মাশরুম, স্পিরুলিনা ইত্যাদি খেতে পারেন।
- ভাত বা রুটি পরিমাণ মতো খাবেন। এছাড়া পছন্দ মতো পাস্তা বা নুডুলস খেতে পারেন।
- সকল প্রকারের মাছ খেতে পারেন। বিশেষ করে, সামুদ্রিক মাছ ও তেল সমৃদ্ধ মাছ খেতে হবে।
- দুধ অথবা দুধের তৈরি টক দই, মাখন, লাবান, ঘি, ঘোল, লাচ্ছি, পনির ইত্যাদি খেতে পারেন।
- প্রতিদিন সবুজ শাক সবজি খেতে হবে। তবে আঁশ জাতীয় শাক সবজি একটু বেশি পরিমাণে খেতে হবে।
- সব প্রকারের বাদাম খেতে পারেন। যেমন- কাঠবাদাম, কাজু বাদাম, চীনা বাদাম, পেস্তা বাদাম, আখরোট ইত্যাদি।
- মুরগি, কবুতর ও কোয়েল পাখির মাংস খেতে পারেন। এছাড়া যারা গরুর মাংস বা খাসির মাংস খেতে পছন্দ করেন তারা মাসের মধ্যে ১-২ বার পরিমান মতো খেতে পারেন। তবে চর্বি খাবেন না।
- রঙিন ফল ও আঁশযুক্ত ফল খেতে পারেন। তবে ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে মিষ্টি জাতীয় ফল এড়িয়ে চলাই ভালো। সেই ক্ষেত্রে টক জাতীয় ফল বেশি খেতে পারেন। যেমন- আমলকি, জলপাই, কমলালেবু, টক বরই, আমড়া, কামরাঙ্গার, জাম্বুরা ইত্যাদি।
- গ্রিন টি খেতে পারেন তবে চিনি ছাড়া খেতে হবে। এছাড়াও অন্যান্য চা, কফি, বিস্কুট, চানাচুর, চিড়া, মুড়ি খাওয়া যাবে। তবে কোন কিছু অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না পরিমান মতো খেতে হবে।
লিভার সিরোসিস রোগীর খাবার তালিকায় যে খাবার গুলো রাখা যাবে না তা হলো-
- মদ্যপান ও ধূমপান একেবাড়েই করা যাবে বা।
- অতিরিক্ত মসলা ও তেল দিয়ে রান্না করা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
- অতিরিক্ত পরিমাণে লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে।
- অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার লিভার সিরোসিস রোগীদের খাওয়া উচিত নয়।
- আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংক পাওয়া যায়। এগুলো পরিহার করতে হবে।
- ফাস্টফুড জাতীয় খাবার সব সময় এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন- বার্গার, পেস্ট্রি, স্যান্ডউইচ, কেক, শিঙাড়া, সমুচা ইত্যাদি।