ক্রিয়েটিনিন কি, এটি কেন বাড়ে, বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ

ক্রিয়েটিনিন কেন বাড়ে

স্বাভাবিক নিয়মে কিডনি রক্ত থেকে অতিরিক্ত ক্রিয়েটিনিন ছেঁকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। যখন এই কাজটি সঠিকভাবে না হবে তখন বুঝতে হবে কিডনিতে কোন সমস্যা রয়েছে। যদি কিডনিতে কোন সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে এক সময় কিডনি বিকল হয়ে যায় এবং মৃত্যুও হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। তার জন্য প্রত্যকের ক্রিয়েটিনিন সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেমন ক্রিয়েটিনিন কি, কেন বাড়ে, বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ ও এর স্বাভাবিক মাত্রা কত ? তা জানা খুবি জরুলি। তাহলে চলুন ক্রিয়েটিনিন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

ক্রিয়েটিনিন কি ?

ক্রিয়েটিনিন হল মাংসপেশির ক্রিয়েটিন ফসফেট ভেঙে তৈরি হওয়া একটি উপাদান। এটি সর্বদা শরীরে নির্দিষ্ট একটি অনুপাতে তৈরি হয়ে থাকে। ক্রিয়েটিনিন যখনই তৈরি হয়, তখনই তা রক্তের সাথে মিশে যায়। পরে যখন রক্ত কিডনির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন কিডনি ক্রিয়েটিনিন ছেঁকে মূত্রের সাথে বেড় করে দেয়।

ক্রিয়েটিনিন কেন বাড়ে ?

রক্তে ক্রিয়েটিনিন বিভিন্ন কারণে বেড়ে যেতে পারে। তবে বাড়ার মূল কারণ গুলো নিচে উল্লেখ্য তুলে ধরা হলো-

  • কিডনিতে সংক্রমণ
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • থাইরয়েড রোগ
  • খুব বেশি প্রোটিন গ্রহণ
  • পানিশূন্যতা
  • অতিরিক্ত শরীরচর্চা
  • প্রি-এক্লাম্পসিয়া ইত্যাদি

ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। লক্ষণগুলো নিচে উল্লেখ্য করা হলো-

  • বমি হওয়া
  • প্রস্রাবে রং বদলে যাওয়া
  • অল্পতে কাল্তি লাগা
  • পেশিতে ঘন ঘন টান ধরা
  • গা গুলানো
  • পায়ের পাতা ও পায়ের গোড়ালি ফুলে যাওয়া
  • প্রস্রাবে গেঁজাভাব দেখানো
  • বার বার প্রস্রাবের বেগ আসা
  • চোখের চারপাশে ফোলা দেখানো

উল্লেখ্য, এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এভাবে যদি দীর্ঘদিন চালতে থাকে তাহলে বড় কোনো সমস্যার সমূখিন হতে পাড়েন।

কোন কোন রোগে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা জরুরি ?

এমন কিছু রোগ আছে যেগুলো থাকলে মাঝে মাঝে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করা উচিত। কেননা এই রোগ গুলো থাকার কারণে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। যেমন-

  • ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে
  • রক্তচাপের সমস্যা থাকলে
  • কিডনিতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে
  • পরিবারে কারো আগে থেকে কিডনির সমস্যা থাকলে
  • থাইরয়েড রোগ থাকলে
  • অটোইমিউন (রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস) রোগ থাকলে

ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা কত ?

ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা নির্ণয় করা হয় লিঙ্গ, বয়স ও শরীরের উপর নির্ভর করে। যেমন-

  • মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ০.৫ - ১.১ মিলিগ্রাম।
  • পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ০.৬ - ১.২ মিলিগ্রাম।
  • যাদের মাত্র একটি কিডনি আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১.৮ মিলিগ্রাম।
  • ১ বছরের কম শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ০.৩ - ০.৭ মিলিগ্রাম।
  • ১ বছরের বড় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ০.৫ - ১.২ মিলিগ্রাম।
আশা করছি রক্তে ক্রিয়েটিনিন লেভেল কত বা স্বাভাবিক মাত্রা কত তা এখান থেকে জানতে পেরেছেন।

রক্তের ক্রিয়েটিনিন নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যে নিয়ম গুলো মেনে চলা উচিত তা হলো-

  1. ফাইবার যুক্ত খাবার: ফাইবার যুক্ত খাবার বেশি পরিমাণে খেতে হবে। কেননা ফাইবার ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যে কারণে কিডনি ভালো থাকে। শাক-সবজি ও ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। তাই প্রতি দিনের খাবারের তালিকা শাকসবজি রাখতে হবে।
  2. লবণ: কারো যদি অতিরিক্ত পরিমাণে লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকে তাহলে তা ত্যাগ করা উচিত। কেননা লবণ রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
  3. ধূমপান ও মদ্যপান: ধূমপান ও মদ্যপান করলে কিডনিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যেতে পারে। যে কারণে সুস্থ থাকতে হলে ধূমপান ও মদ্যপান এড়িয়ে যেতে হবে।
  4. পরিমাণ মতো পানি পান: প্রতিদিন পরিমাণ মতো পানি পান করতে হবে। পানি ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহয়তা করে। তবে অতিরিক্ত পানি পান করা যাবে না।
  5. প্রোটিন: অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়ার ফলে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। তাই অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়া বাদ দেওয়া উচিত।
  6. অ্যাপল সিডার ভিনেগার: ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমাতে অ্যাপল সিডার ভিনেগার বেশ কার্যকারি। অ্যাপল সিডার ভিনেগারে থাকা অ্যাসিটিক এসিড কিডনিতে পাথর জমতে বাধেঁ দেয়। ফলে কিডনি ভালো থাকে এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ থাকে। তাই প্রতিদিন ১ গ্লাস গরম পানিতে ১ চা চামচ অ্যাপল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খেতে পারেন। এটি যে কোনো সময় খাবার খাওয়া পড়ে খেতে পারেন।
  7. দারুচিনি: ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে দারুচিনি বেশ উপকারি। কারণ দারুচিনি প্রাকৃতিক ভাবে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ায়। প্রতিদিন এক টুকরা দারুচিনি বা ১ গ্লাস পানির সাথে আধা চা চামচ দারুচিনি মিশিয়ে ক্ষেতে পারেন।
  8. কঠোর পরিশ্রম: মাংসপেশি যদি অবিরাম কাজ করতে থাকে তাহলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই আমাদের একটানা কঠোর পরিশ্রম করা উচিত নয়। তাই বলে একে বাড়েই পরিশ্রম করবেন না বিষয়টা এমন নয়। পরিশ্রম করবেন তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম করবেন না।
  9. রেড মিট: রেড মিট খাবারে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। যা অন্যান্য প্রোটিন থেকে অনেক বেশি ক্ষতিকর। তাপের সংস্পর্শে এলে এতে থাকা ক্রিয়েটিন ক্রিয়েটিনিনে পরিণত হয়।
    • রেড মিট খাবার বলা হয়- গরুর মাংস, পাঁঠা বা খাসির সাংস, শুকরের মাংস, ভেড়ার মাংস ইত্যাদি।

ক্রিয়েটিনিন কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয় ?

প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ২.০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি হলে তা কিডনি রোগের শেষ পর্যায় নির্দেশ করে। এই পর্যায়ে কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ছেঁকে বের করতে পারে না। ফলে রোগীর জীবন রক্ষার জন্য কিডনি প্রতিস্থাপন বা ডায়ালাইসিস করার প্রয়োজন হয়।

তবে, প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ২.০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি হলেই যে ডায়ালাইসিস করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। ডায়ালাইসিস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রোগীর অন্যান্য শারীরিক অবস্থার (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ ইত্যাদির) উপর নির্ভর করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url