কিডনি রোগের লক্ষণ, প্রতিকার, প্রতিরোধে করণীয় ও বোঝার উপায়
আমাদের দেশে প্রতি ঘন্টায় কিডনি বিকল হয়ে মারা যাচ্ছে ৫ জনেরও বেশি মানুষ। এছাড়াও সারা দেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে আছে প্রায় দুই কোটিরও বেশি মানুষ। তবে এদের মধ্যে অনেকেই জানেন না কিডনি রোগের লক্ষণ বা প্রতিকার সম্পর্কে। আপনারা যদি কিডনি রোগের লক্ষণ বা প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে চান তাহলে আর্টিকেলটি একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
কিডনি আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ। আমাদের এই গুরুত্বপূর্ন কিডনিতে নিরবে রোগ ডুকে পরে। কিন্তু খুব সহযে বা প্রথম দিকে কিডনি রোগের লক্ষণ গুলো খুব একটা বোঝা যায় না, যতক্ষন পর্যন্ত কিডনি রোগ জটিল আকারে ছাড়িয়ে না পারে ততক্ষণ পর্যন্ত কিডনি রোগের লক্ষণগুলো ভালো করে দেখা দেয় না। তাই সকলকে কিডনি রোগের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, যাতে করে এর প্রতিকার করা যায়। নিচে কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
কিডনি রোগের লক্ষণ
কিডনির রোগকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
- একিউট কিডনি ইনজুরি বা আকস্মিক কিডনি বৈকল্য।
- ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগ।
একিউট কিডনি ইনজুরির লক্ষণ
- বুকে চাপ বা ব্যথা লাগা,
- অর্ধনিদ্রিত থাকা,
- নিঃস্বশে দুর্বলতা,
- অবসাদে ভোগা,
- মনোযোগ কমে যাওয়া,
- গা গোলানো,
- শ্বাসকষ্ট হওয়া,
- হৃদরোগ বা কখনো কোমা,
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, আবার মাঝে মাঝে স্বাভাবিক হয়ে যায়,
- কিডনিতে জল জমে যাওয়া, যার কারণে পা, পায়ের গাড়ালি এবং পায়ের পাতা ফুলে যায়।
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ লক্ষণ
- বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব হওয়া,
- অত্যধিক তৃষ্ণা পাওয়া,
- শরীর দুর্বল এবং ক্লান্ত হয়ে পড়া,
- মাংসপেশির ক্ষয়, ক্র্যাম্প, কাঁপানো এবং হাড়ে ব্যথা করা,
- প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া করা,
- বিভ্রান্তি, মানসিক দুর্বলতা এবং তন্দ্রা,
- হাত ও পা অসাড়তা এবং অস্থির লেগ সিন্ড্রোম হয়ে আসা,
- চোখের চারপাশ ফুলে যাওয়া,
- পায়ের গোড়ালি এবং পা ফুলে যাওয়া,
- নখ এবং চুল ভঙ্গুর,
- প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হওয়া,
- শরীরের বেশিরভাগ অংশে চুলকানি বা র্যাশ হওয়া,
- অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ,
- ওজন, ঘুম, ক্ষুধা এবং যৌনতার আগ্রহ কমে যাওয়া,
- বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হওয়া,
- অনিয়মিত প্রস্রাব আউটপুট হওয়া এবং মল ত্যাগের সময় রক্ত যাওয়া।
কিডনি রোগের প্রতিকার
একিউট কিডনি ইনজুরি বা আকস্মিক কিডনি বৈকল্য হয়ে যাওয়া ক্ষেত্রে প্রথমে কারণ নির্নয় করে চিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসাক সাধারণত রোগে নির্ণয় করার জন্য রোগীকে ইলেক্ট্রোলাইট, ক্রিয়েটিনিন ও রক্ত ইউরিয়া পরীক্ষা সহ আরো বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। যদি বমি ও ডায়রিয়ার কারণে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তাহলে স্যালাইন ও পটাশিয়াম দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয়। যদি রক্তের চাপ কমে যায় তাহলে তা স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এসব বাসায় বসে নিজে নিজে করতে যাবেন না, এসব করার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
সঠিক সময় রোগ শনাক্ত করতে না পারলে তা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের দিকে চলে যায়। ফলে কিডনির সমস্যা আরো গভীর হতে থাকে এবং তা এক পর্যায় কিডনি ফেইলিউরের দিকে চলে যায়। তখন ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় এবং স্টেজ এর দিক থেকে যদি শেষ পর্যায়ে হয় বা রেনাল ডিজিজ হয়ে যায়, তাহলে কিডনি ট্রান্সফার বা ডায়ালিসিস মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে হবে।
কিডনি রোগের কারণ ও ঝুঁকির কারণ
বিভিন্ন কারণে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। তবে গবেষণায় জানা গেছে যে প্রায় ২০ - ৩০ শতাংশ ডায়াবেটিসের কারণে, প্রায় ১০-৩০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি নেফ্রাইটিসের কারণে এবং প্রায় ১০-২০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে, বংশগত কারণে, ঔষধের প্রভাবে, কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণে এবং অস্বাস্থ্যকর ডায়েটের কারণে কিডনিতে রোগ হতে পারে।
বর্তমানে কিডনি রোগের প্রধান ঝুঁকি হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস বিবেচনা করা হয়। তবে মস্তিষ্ক ও হার্টে রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত, স্থূলতা, হৃদরোগসহ আরো অন্যান্য রোগের সংক্রামকের কারণে কিডনিতে রোগ হয়। এছাড়াও ষাটোর্ধ্ব বয়সী এবং ধূমপায়ীদের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে থাকে।
কিডনি রোগ প্রতিরোধে করণীয়
কিডনির রোগ প্রতিরোধের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন,
- নিয়মিত ব্যায়াম এবং শারীরিক পরিশ্রম করুন,
- খাবারে অতিরিক্ত লবণের অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করুন,
- ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করুন,
- প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন,
- উচ্চ গ্লাইসেমিক ও চিনিযুক্ত খাদ্য এড়িয়ে চলুন,
- ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন,
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন,
- অতিরিক্ত ব্যথানাশক এবং অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ থেকে সর্তক থাকুন,
- প্রতিমাসে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং কিডনি ফাংশন পরীক্ষা করুন।
কিডনির সমস্যা বোঝার উপায়
কিডনি ৭০-৮০ ভাগ গুরুতরভাবে নষ্ট না হওয়ার আগ পর্যন্ত লক্ষণ দেখা দেয় না। তবে কিডনির সমস্যা দেখা দিলে বেশ কিছু রোগের প্রকোপ বাড়ে। যার কারণে স্বাস্থ্য অবনতি হতে থাকে। যে সকল উপসর্গ দেখা দিলে কিডনির সমস্যা হয়েছে বলে বোঝা যায়। সেই উপসর্গগুলো হলো-
- বারবার মূত্রত্যাগ,
- ত্বকে র্যাশ ও চুলকানি হওয়া,
- শ্বাসকষ্ট হওয়া,
- চোখের চারপাশে ফুলে যাওয়া,
- পিঠের নিচের অংশে ব্যথা হওয়া,
- মূত্রের সাথে রক্ত বের হওয়া,
- খাবারে অরুচি দেখা দেওয়া,
- মূত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে ফেনা হওয়া,
- মুখে দুর্গন্ধ হওয়া,
- মুখ ও পায়ের গোড়ালি ফুলে যাওয়া,
- গরম আবহাওয়ার শীত শীত অনুভূত হওয়া।