লিভার রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

লিভার রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

প্রধান বিপাকীয় অঙ্গগুলোর মধ্যে লিভার হলো অন্যতম একটি। লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর সারা বিশ্ব ১ লক্ষের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এটি দিনে দিনে বেড়েই চলছে। ধূমপান, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, মানসিক চাপ ইত্যাদি কারণে লিভারে সমস্যা হচ্ছে। ঔষধ, সংক্রমণ, স্থূলতাসহ বিভিন্ন কারণে লিভারের রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

নিচে লিভার রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো-

লিভার রোগের লক্ষণ

প্রাথমিক অবস্থায় লিভার রোগে আক্রান্ত হলে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে যে উপসর্গ বা লক্ষণ গুলো প্রকাশ পায় তা নিচে তুলে ধরা হলো-

  1. খাবারে অরুচি,
  2. ক্লান্তি লাগা,
  3. পায়ের গোড়ালি ও পায়ের পাতা ফুলে ওঠা,
  4. প্রস্রাবের বর্ণহীনতা,
  5. পেট ফুলে ওঠা,
  6. বমি বমি ভাব হওয়া বা বমি হওয়া,
  7. পেটে ব্যথা হওয়া,
  8. হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া,
  9. জয়েন্ট জয়েন্টে ব্যথা হওয়া,
  10. ত্বকে চুলকানি হওয়া,
  11. সহজ কালশিরা পড়া,
  12. কাদামাটি ও আলকাতরার মতো ফ্যাকাশে মল হওয়া,
  13. চোখ রং হলুদ হয়ে যাওয়া।

উপরের উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবহেলা না করে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। যদি দেরি করেন তাহলে লিভারের বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই এই সব বিষয়ে আবশ্যয় সাবধান হতে হবে।

লিভার রোগের প্রতিকার

লিভার রোগের চিকিৎসা বা প্রতিকার নির্ভর করে রোগের ধরন ও তীব্রতার উপর। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় তাহলে জীবন যাপনে কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে লিভার রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

নিচে লিভার রোগের প্রতিকার গুলো তুলে ধরা হলো-

  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
  • অ্যালকোহল খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে।
  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের মেডিসিন বা ওষুধ সেবন করা যাবে না।
  • নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করতে হবে এবং ডাক্তারের করা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেডিসিন ও খাবার দাবার গ্রহণ করতে হবে।

তবে, কারো যদি লিভার সিরোসিস হয়ে যায় তাহলে লিভার প্রতিস্থাপন বা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা লাগতে পারে। তাই লিভারের কোনো সমস্যা দেখা দিলে একজন ডাক্তার পরামর্শ গ্রহন করুন এবং সুস্থ থাকুন।

ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায়

লিভার কোষে ফ্যাট জমলে তাকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। ফ্যাটি লিভার ঠিক সময় চিহ্নিত করতে না পারলে স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টির কারণ হতে পারে। ফ্যাটি লিভার চিহ্নিত করার পর, সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য খাদ্য অভ্যাস ও জীবন যাপনের পরিবর্তন আনতে হবে।

নিচে ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় গুলো বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলো-

  1. ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পেতে খাবারের তালিকায় মৌসুমি ফলমূল যুক্ত করতে পারেন।
  2. যারা অ্যালকোহল ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত তাদের কে প্রথমেই অ্যালকোহল ত্যাগ করতে হবে।
  3. ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অবশ্যই মিনারেল ও ভিটামিন জাতীয় খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
  4. প্রতিদিনের খাবার তালিকায় একটি করে সিদ্ধ ডিম রাখতে পারেন। দুগ্ধজাতিয় খাবারের মধ্যে রাখতে পারেন নন ফ্যাট মিল্ক ও টক দই।
  5. ফাইবার যুক্ত খাবার হজমে সহায়তা করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে পেট ভরা রাখে। তাই খাবারের তালিকা ফাইবার যুক্ত খাবার রাখতে হবে।
  6. ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দূর করার জন্য খাদ্য তালিকায় শাকসবজি রাখতে হবে। যেমন- গাজর, ব্রকলি, লেটুস, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, বিটরুট, শিম ইত্যাদি।
  7. খাবার তৈরিতে অতিরিক্ত পরিমাণে তেল ব্যবহার করা যাবে না। অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও মশলা জাতীয় খাবার খুব অল্প পরিমাণে খেতে হবে (না খেলে আরো ভালো হয়)।
  8. কারো যদি দুধ চা বা কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে কফি বা চা খাওয়ার অভ্যাস থাকে তাহলে তা ত্যাগ করতে হবে। এছাড়া ঘন দুধ দিয়ে তৈরি করা খাবার বা ফুল ক্রিম মিল্ক খাওয়া যাবে না।
  9. ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দূর করার জন্য ব্যায়াম করা অন্তত জরুরি। তাই প্রতিদিন সকালে কমপক্ষে ১৫-২০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। এতে করে লিভার ভালো থাকবে এবং ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
  10. ফ্যাটি লিভার হলে একেবারে প্রোটিন বাদ দিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। উন্নত মানের প্রোটিন খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন। তবে খাবার খাওয়ার আগে কিছু বিষয় আপনার লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন- মাছ খেলে মাছের চর্বি বাদ দিয়ে খেতে হবে, মাংস খেলে মাংসের চামড়া খাওয়া যাবে না। এছাড়া যদি গরু বা খাসির মাংস খেতে পছন্দ করেন তাহলে ১ বা ২ টুকরা মাংস খেতে পারেন তবে তা শুধুমাত্র এক বেলা। মাংস খাওয়ার সময় অবশ্যই মনে রাখবেন চর্বি অংশ বাদ দিয়ে শুধু সলিড মাংস খেতে হবে।

ফ্যাটি লিভার রোগীর খাদ্য তালিকা

ফ্যাটি লিভার রোগীদের খাবার দাবারে অনেক সচেতন হতে হবে। কেননা তাদেরকে সব ধরনের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু অনেকেই জানেন না কোন কোন খাবার গ্রহন করা এই সময় ভালো হবে। তাদের জন্য নিচে ফ্যাটি লিভার রোগীর খাদ্য তালিকা তুলে ধরা হলো-

  1. সবুজ শাকসবজি: সবুজ শাকসবজিতে ভরপুর মাত্রায় পলিফেনল ও নাইট্রেট রয়েছে, যা লিভার থেকে চর্বি কমাতে সাহায্য করে। তবে রান্না করে খেলে বা সিদ্ধ করে ফেলে দিলে পলিফেনল এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কার্যকারিতা কমে যায়। তাই যে সবজিগুলো কাঁচা খাওয়া যায় সেই সকল সবজি খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। যেমন- শসা, লেটুস ইত্যাদি।
  2. লেবু, টক দই: শরীর থেকে যত টক্সিন বেড়িয়ে যাবে লিভার তত বেশি ভালো থাকবে। শরীর থেকে টক্সিন বের করার জন্য গরম পানির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ও কয়েক বার পান করতে পারেন। এছাড়া খাদ্য তালিকায় টক দইয়ের মতো প্রোবায়োটিক রাখতে পারেন।
  3. ডাল ও বীজ জাতীয় খাবার: ছোলা, মটরশুঁটি, ডাল ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও স্টার্চ রয়েছে। যা পরিপাকতন্ত্রের জন্য অনেক উপকারি। এছাড়া এই পুষ্টিকর উপাদানগুলো ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে।
  4. সামুদ্রিক মাছ: পমফ্রেট, ইলিশ, রূপচাঁদা ইত্যাদি মাছের মধ্যে মেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমিয়ে লিভারের প্রদাহ ও চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
  5. মশলাপাতি: কাঁচা হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন লিভারের জন্য অনেক উপকারী। তাই প্রতিদিন রাতে দুধের সাথে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে খেতে পারেন। এছাড়াও কাঁচা রসুন লিভারের প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url