কিডনি রোগ ভাল হয় কিনা, রোগের ধরন, কেন হয় ও জীবনধারা

কিডনি রোগ কি ভাল হয়

জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউটের সর্বশেষ আপডেট অনুসারে জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ % অথবা ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই কিডনি রোগ জটিল একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক বিপদজনক। মূলত কিডনি রোগের তীব্রতা, ধরন ও চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে কিডনির রোগ ভাল হবে কিনা।

তাই আমাদের সকলের উচিত কিডনি রোগ নিয়ে সর্তক থাকা। আর সর্তক থাকার জন্য জেনে নিন কিডনি রোগ কেন হয়, কিডনি রোগ কাদের হতে পারে সেই সম্পর্কে।

কিডনি রোগ কি ভাল হয়

কিডনির রোগ হলো এমন একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা, যা রক্ত থেকে অতিরিক্ত তরল পদার্থ ও বর্জ্য অপসারণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। কিডনি রোগ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে মূল কারণগুলো হলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং অতিরিক্ত ব্যথানাশক ওষুধ সেবন। এছাড়াও বংশগত কারণে কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে যদি চিকিৎসা করা যায়, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনির কার্যকারিতা কিছুটা উন্নতি করা যায়। তবে দীর্ঘ দিন ধরে কিডনি রোগে ভোগার কারণে কিডনি ফেলিওর বা রেনাল ডিজিজ হয়ে গেলে, ডায়লাসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা করা লাগতে পারে।

কিডনি রোগের ধরন

কিডনির রোগকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো আকস্মিক কিডনি বৈকল্য বা একিউট কিডনি ইনজুরি এবং অন্যানটি হলো দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ। আকস্মিক কিডনি সমস্যা বেশিরভাগ সময়ে পুরোপুরি নিরাময় হয়ে যাই, তবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ভুগতে পারেন। তবে কারো যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হয়ে যায়, তাহলে তা পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়। তবে রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে ভালোভাবে বাঁচা যায় এবং সকলের মতো সক্রিয় থাকা যায়। এসব কিছু সম্ভব হবে রোগের জটিলতা বাড়ার গতিকে কমিয়ে আনার মধ্যমে। তবে এর জন্য কিছু বিষয় নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

সব কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস ও কিডনি ট্রান্সফার করা লাগে না। তবে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে কিডনির রোগে ভুগতে থাকলে কোনো এক পর্যায় কিডনির সক্ষমতা শেষ পর্যায় নেমে আসে, তখন রোগীকে বুঝতে হবে তাকে সারা জীবন ডায়ালাইসিস নিতে হবে কিংবা কিডনি ট্রান্সফার করাতে হবে।

কিডনি রোগ কেন হয়

কিডনির রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে এর মূল কারণগুলো হলো-

  1. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে,
  2. বারবার মূত্রনালী সংক্রমণ হলে,
  3. কিনডিতে পাথর হলে,
  4. জন্মগত সমস্যা থাকলে,
  5. নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে,
  6. ধূমপান এবং মদ্যপান করলে,
  7. পরিমাণ মতো পানি পান না করলে,
  8. অস্বাস্থ্য কর খাবার গ্রহণ করলে,
  9. নিয়মিত ব্যথানাশক বা পেইন কিলার সেবন করলে।

যাঁদের হতে পারে কিডনির রোগ

দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির প্রদাহ অথবা মূত্রনালিতে বাঁধা সৃষ্টিকারী কোনো সমস্যা থাকলে কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া জন্মগত সমস্যা থাকলে কিডনিতে রোগ হতে পারে। একজন সুস্থ মানুষের হঠাৎ করে পাতলা পায়খানা ও বমি হওয়ার কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, যদি পাতলা পায়খানা ও বমির সাথে বেরিয়ে যাওয়া পানি ও লবণের ঘাটতি তখনি পূরণ না করে। যারা প্রায়ই ব্যথানাশক ওষুধ বা পেইনকিলার সেবন করেন তাদের কিডনিতে সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও যারা অতিরিক্ত পরিমাণে আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করেন তাদের কিডনিতেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কিডনি রোগী কতদিন বাঁচে

একজন কিডনি রোগী কত দিন বাঁচে তা মূলত নির্ভর করে তার রোগের তীব্রতার উপর। কারণ একজন রোগীর কিডনি যদি কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে তাহলে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ এবং উন্নতমানে চিকিৎসার মধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারবেন।

আবার কারো যদি দুইটা কিডনিই বিকল হয়ে যায় বা ৮০% নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে সে কিডনি প্রতিস্থাপন বা ডায়ালাইসিস এর মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারবেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ডায়ালাইসিস নেওয়া নির্ভর করে রোগীর ক্ষমতার উপরে। কারণ একজন রোগী ডায়ালাইসিস নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ৫-১০ বছর বেঁচে থাকতে পারেন। তবে দেখা যায় অনেক রোগী ২০ বছর এমন কি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ডায়ালাইসিস নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন।

আর যদি কিডনি প্রতিস্থাপন করেন তাহলে আপনার কিডনি কতদিন ভালো থাকবে তা নির্ভর করবে জীবিত ও মৃত দাতার উপরে। যদি জীবিত দাতার কাছ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন তাহলে ১৫-২০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে কিডনি ভালো থাকতে পারে এবং মৃত দাতার কাছ থেকে যদি কিডনি প্রতিস্থাপন করেন তাহলে গড়ে ১০-১৫ বছর কিডনি ভালো থাকতে পারে।

কিডনি রোগীর জীবনধারা

কিডনি রোগ ধরা পড়লে জীবনধারায় পরিবর্তন আনা জরুরি। যাতে করে কিডনি রোগ ছড়িয়ে পড়তে না পরে। বিশেষ করে খাবারের ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ কিডনি রোগীরা চাইলে সব ধরনের খাবার খেতে পারেন না। তাদের খাবারের ব্যাপারে অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলা উচিত।

সবজি

রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা, পটাশিয়াম ও ফসফরাস ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে কিডনি রোগীদের জন্য সবজি নির্নয় করা হয়। কিডনির রোগীদের অতিরিক্ত পিউরিন ও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ শাক-সবজি, লাল রঙের শাকসবজি ও পিচ্ছিল যুক্ত শাকসবজি এড়িয়ে চলা উচিত। চিচিঙ্গা, চাল কুমড়া, ঝিঙ্গা ইত্যাদি পানীয় জাতীয় সবজি কিডনি রোগীদের জন্য বেশ উপকারি। তবে মনে রাখবেন এই সবজিগুলো পরিমাণ মতো খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিডনি রোগীদের কাঁচা সবজির সালাদ সবজি সুপ্য ইত্যাদি খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।

তরল বা পানীয়

কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে তরল খাবার অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়। কারণ একজন রোগী কতটুকু তরল খাবার খাওয়া উচিত তা র্নিভর করবে রোগীর অবস্থার ওপরে। শরীরের হিমোগ্লোবিন, ইজিএসআর, ইডিমা ও সোডিয়ামের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে কিডনি রোগীদের জন্য প্রতিদিন দেড় লিটর করে তরল বরাদ্দ করা হয়, তবে কখনো কখনো দুই লিটার করে তরল বরাদ্দ করা হয়। অনেকেই অসুস্থ কিডনি সুস্থ করার জন্য অতিরিক্ত পানি পান করেন, তবে এটা করা উচিত নয়।

লবণ

শারীরিক অবস্থা ও ডায়েটিশিয়ানের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত কিডনি রোগীদের জন্য ২ থেকে ৫ গ্রাম লবণ খাওয়া বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। তাই কিডনি রোগীদের অতিরিক্ত সোডিয়াম যুক্ত খাবার এবং আলাদা লবণ খাওয়া পরিহার করতে হবে।

কিডনি রোগীর নিষিদ্ধ খাবার

কিডনি রোগীদের যে সকল খাবার খাওয়া উচিত নয়। যেমন- ফুলকপি, পালংশাক, মুলাশাক, কচু, মুলা, বাঁধাকপি, কাঁঠালের বিচি, পুঁইশাক, ঢেঁড়স, গাজর, শিমের বিচি ইত্যাদি। আর প্রাণিজ খাবারের মধ্যে যে খাবারগুলো সীমিত খাওয়া উচিত। সেগুলো হলো- মাছ, দুধ, মাংস, ডিম ইত্যাদি।

কলা, ডাব, আঙুর একেবারেই খাবেন না, কেননা এই খাবারগুলোতে পটাশিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই এই খাবারগুলো খেলে রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা বাড়তে থাকে। তবে কম পটাশিয়াম যুক্ত ফল খেতে পারেন। যেমন- নাশপাতি, আপেল, পাকা, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url