গর্ভাবস্থায় সহবাসের উপকারিতা, অপকারিতা, নিয়ম ও নিষিদ্ধ সময়

গর্ভাবস্থায় সহবাস করার উপকারিতা

বেশির ভাগ দম্পত্তির মনে একটি প্রশ্ন থাকে, যে তারা গর্ভাবস্থায় সহবাস করতে পারবে কিনা বা গর্ভাবস্থায় সহবাস করা নিরাপদ কিনা। বিশেষ করে মেয়েদের মনে এই প্রশ্নটি বেশি থাকে। গর্ভাবস্থায় অনেক মেয়ের স্বাভাবিক ভাবেই যৌনতার চাহিদা থাকে না। কিন্তু অনেক মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক তার উলটো হয়, তাদের যৌন চাহিদা আগের থেকে আরো বেশি বেড়ে যায়। যে কারণে মেয়েদের মনে প্রশ্ন উঠে আসে গর্ভাবস্থায় যৌনতায় মাতলে বা সহবাস করলে অনাগত সন্তানের কোন ক্ষতি হবে কিনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, কারো যদি গর্ভাবস্থা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে তাহলে কিছু নিয়ম মেনে একটা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত সহবাস করা যাবে।

গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক সহবাস করা যেতেই পারে এতে করে অনাগত শিশুর কোন প্রকার ক্ষতি হবে না। কারণ হচ্ছে গর্ভে থাকা অনাগত সন্তান তলপেট এবং জরায়ুর শক্ত পেশি দ্বারা সুরক্ষিত থাকে, তার সাথে অ্যামনিওটিক থলির তরলও থাকে। যে কারণে গর্ভাবস্থায় সহবাস করলে ক্ষতির সম্ভবনা থাকে না। তবে অবশ্যয় কিছু নিয়ম মেনে এই সময় সহবাস করতে হবে। এছাড়া কারো যদি কোন জটিলতা থাকে তাহলে গর্ভাবস্থায় সহবাস করা উচিত হবে না। চলুন তাহলে যেনে নেওয়া যাক গর্ভাবস্থায় সহবাস সম্পর্কে।

গর্ভাবস্থায় সহবাস করার উপকারিতা

গর্ভাবস্থায় যৌন চাহিদাকে দমন করে রাখার কোনো কারণ নেই। সহবাস আপনার বা গর্ভের সন্তানের কোনো ক্ষতি করবে না। সুস্থ গর্ভাবস্থায় সহবাস করা একেবারেই নিরাপদ এবং এর সাথে বেশ কিছু উপকারিতাও রয়েছে। চলুন তাহলে যেনে নেওয়া যাক গর্ভাবস্থায় সহবাস করার উপকারিতা গুলো-

  1. গর্ভাবস্থায় সহবাস করার কারণে শরীরে রক্ত সরবরাহ দ্বিগুণ হয়। এতে করে মা এবং ক্রমবর্ধমান শিশুর প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণে সাহায্য করে।
  2. সহবাস করার ফলে যে হরমোন নিঃসরণ হয় তা ভ্রূণের অতিরিক্ত অক্সিজেন ও পুষ্টির সরবরাহে সাহায্য করে। এটি ভ্রূণের বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
  3. গর্ভাবস্থায় সহবাস করলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা যায়। সহবাস এই সময় মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, ফলে রাতে ঘুম ভালো হয়।
  4. গর্ভাবস্থায় সহবাসের সব থেকে বড় উপকারিতা গুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল পেলভিক ফ্লোরের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করা।
  5. গর্ভাবস্থায় নিয়মিত সহবাস করার ফলে সহজ প্রসব বা নরমাল ডেলিভারি হতে সহায়তা করতে পারে।
  6. গর্ভাবস্থায় নিয়মিত সহবাস প্রসব সহজ করার সাথে সাথে যৌনির পেশীগুলিকে টোন করে ও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
  7. শুক্রাণুর কিছু উপাদান গর্ভবতী নারীর শারীরিক বেদনা দায়ক পরিস্থিতি হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে।
  8. সহবাসের পরে প্রকাশিত হরমোন গুলির কারণে পুরো শরীর একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আরামদায়ক পরিবেশে চলে যায়, যা গর্ভাবস্থায় রক্তচাপের প্রবনা কমাতে সাহায্য করে।
    • তবে এটি প্রি-এক্লাম্পসিয়া (Preeclampsia) হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে না।
  9. গর্ভাবস্থায় অনেক নারীর প্রস্রাবের প্রবণতা বেড়ে যায়। অনেক সময় হাসি, কাশি বা হাঁচির সময় সামান্য প্রসাব বের হয়ে যায়। এই সমস্যার থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত সহবাস করা প্রয়োজন। কারণ সহবাস যৌনির আশে পাশের পেশী সংকোচন করতে এবং তাদের শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। ফলে প্রস্রাবের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
  10. গর্ভাবস্থায় শারীরিক অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তন গুলোকে ঘিরে মনে নানান ধরনের চিন্তা ঘূর পাক খায়। এই সব চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে নিয়মিত সহবাস করা প্রয়োজন। এতে করে আত্মমর্যাদাবোধ উন্নত হয় এবং নিজেকে চিন্তা মুক্ত রাখতে পারে।
  11. গর্ভাবস্থায় নিয়মিত সহবাস পেলভিক পেশীকে সংকুচিত করতে এবং জরায়ুকে খুলতে সাহায্য করে। যা নরমাল ডেলিভারি হতে সাহায্য করে।

নোট: এই সব উপকারিতা শুধুমাত্র সুস্থ ও স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার জন্য। যদি কারো গর্ভাবস্থায় কোন প্রকার জটিলতা দেখা যায় তাহলে আবশ্যয় চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করবেন। কারণ কিছু কিছু অস্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় সম্পূর্ণ বেড রেস্ট থাকার প্রয়োজন হয়। সেই ক্ষেত্রে সহবাস করলে গর্ভবতী মা ও আনাগত সন্তানের ক্ষতি হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় সহবাস করার অপকারিতা

সুস্থ ও স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় সহবাস করলে কোনো ক্ষতি বা অপকারিতা নেয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় সহবাস করা মারাত্বক ক্ষতির কারণ হতে পারে। চলুন তাহলে যেনে নেওয়া যাক গর্ভাবস্থায় সহবাস করার অপকারিতা সমূহ-

  1. কোন কারণে যদি গর্ভাবস্থায় মাসিকের রাস্তা দিয়ে প্রচুর পরিমাণে রক্তপাত হয় তাহলে সহবাস করলে মা ও সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। এমনকি গর্ভের সন্তান মারাও যেতে পারে।
  2. গর্ভবতী মায়ের জরায়ুর (সারভিক্সের) মুখে কোন জটিলতা বা দুর্বলতা থাকে তাহলে এই সময় সহবাস থেকে দূরে থাকুন।
  3. গর্ভবতী মায়ের জরায়ু যদি ছোট থাকে বা জরায়ুর অক্ষমতা থাকে তাহলে সহবাস থেকে দূরে থাকুন।
  4. পূর্বের গর্ভাবস্থাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই যদি সন্তান প্রসব হয়ে থাকে তহলে সহবাস না করাই উত্তম।
  5. অনেক নারীর গর্ভফুল (প্লাসেন্টা) নিচের দিকে থাকে। যাকে মেডিকেল ভাষায় "প্লাসেন্টা প্রিভিয়া" বলা হয়। এ ক্ষেত্রে সহবাস করলে রক্তপাত হওয়ার ঝুকি থাকে।
  6. কোন কারণে প্রসবের আগেই যদি পানি ভেঙ্গে যায় তাহলে সহবাস বিপদ জনক হতে পারে।
  7. গর্ভবতী মায়ের পেটে যদি দুই বা তার বেশি (মানে জমজ) সন্তান থাকে তাহলে সহবাস করা উচিত হবে না।

গর্ভাবস্থায় সহবাস করার নিয়ম

যদিও বেশির ভাগ দম্পতির জন্য গর্ভাবস্থায় সহবাস করা একেবারেই নিরাপদ, তবুও সবসময় এটি সহজ হতে নাও পারে। স্বাভাবিক সময়ের মত গর্ভাবস্থায় সহবাস করতে সমস্যা হতেই পারে। সে জন্য বিভিন্ন ভাবে অবস্থান বা পজিশন চেঞ্জ করে সহবাস করার চেষ্টা করুন। এক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীর ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারটিই মূল বিষয়। তবে গর্ভাবস্থায় সহবাস করার ফলে গর্ভবতী মা বা গর্ভের সন্তান যেন কোনো ভাবেই আঘাত না পায় সে দিকে সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে।

গর্ভাবস্থায় সহবাস করার সময় স্বামী স্ত্রীর উপরে থাকলে যে ক্ষেত্রে স্ত্রীর জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর হতে পারে। যেহেতু এসময় তার পেট আকারে বড় থাকে, সেই সাথে তার স্তন ও শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথা অনুভব হতে পারে। যে কারণে এইসময় স্বামীর পরিবর্তে স্ত্রী উপরে থাকতে পারেন। আবার স্ত্রী সামনে এবং স্বামী পেছনে অবস্থান করেও সহবাস করতে পারেন।

এছাড়াও গর্ভাবস্থায় সহবাস করার সময় পুরুষাঙ্গ যৌনির অনেক গভীরে চলে গেলেও অস্বস্তি লাগতে পারে৷ এসব সমস্যা থেকে বাচতে শুয়ে যেকোনো একদিকে কাত হয়ে সহবাস করার চেষ্টা করুন।

নোট: অনিরাপদ সহবাস করার ফলে নানা ধরনের যৌন বাহিত রোগ ছড়াতে পারে যা গর্ভের সন্তানের দেহে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে৷ তাই গর্ভাবস্থায় সহবাস করার ক্ষেত্রে নিজেকে ও গর্ভের সন্তানকে এসব যৌনবাহিত রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে কনডম ব্যবহার করুন।

গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস সহবাস করা যাবে কি?

যেহেতু গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যে কারণে এই সময় সহবাস করা যথেষ্ট নিরাপদ হবে কিনা তা জানা খুবি জরুলি। বিশেষ করে সদ্য গর্ভবতী হওয়া মহিলারা এটি জানতে চান। কারণ এসময় মহিলারা বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, খাবারে অরুচি, মর্নিং সিকনেসসহ নানান সমস্যায় ভোগেন।

মর্নিং সিকনেসের কারণে গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক সপ্তাহ খুব ক্লান্ত বোধ করেন, যদি এই সময় যৌন ইচ্ছে না থাকে তাহলে এই সময়টায় সহবাস না করাই ভালো। যখন স্বাভাবিক বোধ করবেন বা যৌন ইচ্ছা জাগলে তবেই সহবাস করা উচিত। এক কথায় বলতে গেলে, প্রথম তিন মাসসহ পুরো গর্ভাবস্থায় সহবাস করা নিরাপদ।

অনেকেই আশঙ্কা করেন যে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস এবং শেষের তিন মাস সহবাস করলে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। তবে এই ধারণাটি সঠিক নয় সম্পূর্ন ভূল ধারণা।

গর্ভাবস্থায় সহবাস করার নিষিদ্ধ সময়

গর্ভাবস্থা যদি স্বাভাবিক থাকে এবং নির্দিষ্ট কোন স্বাস্থ্য জটিলতার কারণে চিকিৎসক সহবাস থেকে বিরত থাকার পরামর্শ না দিয়ে থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় সহবাস করা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। এতে গর্ভের সন্তানের কোন ধরনের আঘাত পাওয়া বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তবে গর্ভাবস্থায় অনেকেরই সহবাসের ইচ্ছা থাকে না যা স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে দুচিন্তা করার কোনো কারণ নেই। এমনটা হলে আপনার সঙ্গীর সাথে বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন। এই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url