ফখরুদ্দিন আহমেদ এর জীবন ইতিহাস

ফখরুদ্দিন আহমেদ

ফখরুদ্দীন আহমেদ হলেন একজন বাংলাদেশী সাবেক সচিব, অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) এর সাবেক গভর্নর। দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে ১২ জানুয়ারি ২০০৭ সালে তিনি "বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের" প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

জন্ম:

ব্রিটিশ ভারতের মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগিবাড়ী উপজেলার ধীপুর ইউনিয়নের রব নগরকান্দি গ্রামে ১৯৪০ সালের পহেলা মে ফখরুদ্দীন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন (বর্তমান বাংলাদেশ)। ফখরুদ্দিন আহমেদ এর পিতার নাম ডাঃ মহিউদ্দিন আহমেদ।

শিক্ষা জীবন:

টংগিবাড়ী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন ফখরুদ্দিন আহমেদ। তারপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে ১৯৬০ সালে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। তারপরে যুক্তরাষ্ট্রের "মাসাচুয়েটসের উইলিয়ামস কলেজ" থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং "প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়" থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবন:

ফখরুদ্দিন আহমেদ তার শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার পরে কিছু কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর তৎকালীন পাকিস্তানের কর্মকমিশনে যোগ দেন তিনি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ কর্ম কমিশনে চাকরি করেন। সেই বছরই তিনি বিশ্ব ব্যাংকে যোগদান করেন এবং বিভিন্ন পদ পার করে ব্যাংকের উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্বব্যাংকের উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে ২০০১ সালের ১৯শে নভেম্বর এবং গভর্নর হিসেবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে (বাংলাদেশ ব্যাংক) যোগদান করেন। গভর্নর হিসেবে তার মেয়াদ ২০০৫ সালের ৩০শে এপ্রিল শেষ হওয়ার পর "পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন"(পিকেএসএফ) কর্মরত ছিলেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা:

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা তৈরি হওয়া বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। তার সাথে সেনা সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়, যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ফখরুদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ করা হয়।

ফখরুদ্দিন আহমেদ কেয়ার টেকার ছিলেন ২ বছর, তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কমিয়ে অনেন এবং এর জন্য তিনি বেশ প্রশংসিত হন। কারণ সেই সময় বিশ্বের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আমাদের সোনার বাংলাদেশ পরিচিত ছিলেন, কিন্তু ফখরুদ্দীন আহমেদ দুর্নীতি বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সে সময় দেশের প্রায় ১৬০ জন রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তার নামে অর্থ আত্মসাৎ সহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। এমনকি দেশের ভূত পূর্ব দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, এতে "আওয়ামী লীগ" দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করেন এবং ফখরুদ্দিন আহমেদের গঠিত "তত্ত্বাবধায়ক সরকার" বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে জনসম্মুখে ফখরুদ্দিন আহমেদকে আর দেখা যায় না।

ফখরুদ্দীন আহমদের মন্ত্রিসভা

ফখরুদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ১১ জানুয়ারী ২০০৭ সালে গ্রহণ করেছিলেন এবং সরকার গঠনের জন্য তিনি ১৩ জন উপদেষ্টা সাথে নিয়েছিলেন। নিচে উপদেষ্টাদের নাম তুলে ধরা হলো-

  1. ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন
  2. এ. বি. মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম
  3. এম এ মতিন
  4. তপন চৌধুরী
  5. বেগম গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী
  6. আইয়ুব কাদরী
  7. এএসএম মতিউর রহমান
  8. আনোয়ারুল ইকবাল
  9. ইফতেখার আহমদ চৌধুরী
  10. চৌধুরী সাজ্জাদুল করিম
  11. এ এম এম শওকত আলী
  12. এ এফ হাসান আরিফ
  13. গোলাম কাদের
  14. রাশেদা কে চৌধুরী
  15. হোসেন জিল্লুর রহমান

ফখরুদ্দিন আহমেদের শাসনামলে ইতিবাচক দশটি দিক:

দুর্নীতি বিরোধী অভিযান: ফখরুদ্দিন আহমেদ সরকার একটি ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে। যা দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ ব্যক্তিত্বদের উপর কড়া নজর দারি করে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে।

নির্বাচন সংস্কার: তার শাসনামলে দেশে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য আরও স্বচ্ছ এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কারের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা করা হয়েছিল।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ফখরুদ্দিনের প্রশাসন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছিল, যে কারণে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পেরেছিলেন।

অবকাঠামো উন্নয়ন: রাস্তা, সেতু ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সহ অবকাঠামো উন্নতির দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন, যা পরিবহন এবং সংযোগের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

শিক্ষা উদ্যোগ: দেশে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য তিনি স্কুলে বিনিয়োগ এবং শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষা খাতের উন্নয়নের প্রচেষ্টা করেন।

স্বাস্থ্য পরিচর্যার উন্নতি: স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে এবং সাধারণ জনগণের জন্য চিকিৎসা পরিষেবার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রদর্শন করে, ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করেছেন।

জননিরাপত্তা: জননিরাপত্তার জন্য আইন প্রয়োগের উন্নতির ব্যবস্থা নেন, যার ফলে এই সময়ের মধ্যে অপরাধের হার হ্রাস পেয়েছিল।

কূটনৈতিক সম্পর্ক: সরকার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে কাজ করেছে, যা অন্যান্য দেশের সাথে ইতিবাচক সম্পৃক্ততায় অবদান রাখতে পেরেছিল।

জাতীয় ঐক্য: ফখরুদ্দিন আহমেদ সরকার জাতীয় ঐক্যের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিল এবং রাজনৈতিক বিভাজন দূর করার জন্য কাজ করেছিল, আরও সমন্বিত সমাজের জন্য প্রচেষ্টা করেছিলেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url