ব্রিকেট মাছ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য

ব্রিকেট মাছ

ব্রিকেট মাছ একটি বিদেশি মাছ। তবে বর্তমানে আমাদের দেশেও এই মাছের চাষ করা হয়। মাছটি খুবি সুস্বাদু ও দ্রুত বর্ধনশীন একটি মাছ। যে কারণে দিন দিন বাজারে এর চাহিদা বেড়েই চলছে এবং চাষীরা ও এই মাছ চাষ করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আজকে আমরা এই পোষ্টে ব্রিকেট মাছ সম্পর্কে অলোচনা করব।

ব্রিকেট মাছের পরিচিতি

ব্রিকেট মাছের দেহের মধ্যঅংশ চওড়া, মাথা ও লেজের দিক সরু। এ মাছ দেখতে অনেকটা সিলভার কার্প মাছের মতই তবে সিলভার কার্প মাছের মাথার থেকে ব্রিকেট মাছের মাথা কিছুটা বড় হয়। এর দেহে ছোট ছোট রুপালি রঙের আঁশ দিয়ে ঢাকা থাকে। নদী, খাল-বিল, পুকুর, হাওড় ও বাওড়ের পানির উপরের স্তরে বাস কারে ব্রিকেট মাছ।

ব্রিকেট মাছের রোগবালাই

পুকুরে অতিমাত্রায় কীটনাশক ওষুধ ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে ব্রিকেট মাছের দেহে নানা ধরনের পচন রোগ দেখা দিতে পারে।

ব্রিকেট মাছের পুষ্টিগুণ

ব্রিকেট মাছে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে। এতে প্রোটিন, ফ্যাট, লৌহ, ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস রয়েছে যা আমাদের দেহের জন্য খুবি উপকারী।

ব্রিকেট মাছ চাষ পদ্ধতি

ব্রিকেট মাছ চাষ করতে কোনো ঝামেলা করতে হবে না। সাধারনত যেভাবে রুই, সিলভার কার্প মাছ চাষ করা হয় সেভাবেই এই মাছ চাষ করতে পারবেন। এই মাছ মিশ্র ভাবেও চাষ করতে পারবেন। নিচে ব্রিকেট মাছ চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো-
  1. পুকুর নির্বাচন: ব্রিকেট মাছ চাষ করার জন্য প্রথমে পুকুর বা জলাশয় নির্বাচন করা হবে। বড় ছোট সব বদ্ধ জলাশয়েই মাছ চাষ করা যাবে। তবে জলাশয়ে সারা বছরই ১-২ মিটার (৩-৬ ফুট) পানি থাকতে হবে। কাদা যুক্ত দোআঁশ, দোআঁশ, পলি যুক্ত কাদা ও এটেল মাটির পুকুর মাছ চাষের জন্য উত্তম।
  2. পুকুরের পাড় মেরামত: বর্ষার মৌসুমে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। অনেক সময় দেখা যায় অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে পুকুরের পাড় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে বা ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। যাতে এমন পরিস্থিতি উৎপন্ন না হয় সেজন্য পুকুরের পাড় ভাঙ্গা থাকলে তা মেরামত করতে হবে। বন্যায় পানি যাতে মাছ ভাসিয়ে নিয়ে না যেতে পাড়ে তার জন্য প্রয়োজন মাফিক পাড় উঁচু করে নিতে হবে।
  3. পুকুর পাড়ের ঝোপ-ঝাড় পরিস্কার: পুকুর পাড়ে ঝোপ-ঝাড় থাকলে তার মধ্যে সাপ, উদ, ইঁদুর ইত্যাদির দেখা দিতে পারে। ফলে এরা পুকুরের মাছ খেয়ে ক্ষতি করতে পারে। ইঁদুর মাছ না খেলেও পুকুর পাড়ে গর্ত করে পাড় নষ্ট করতে পাড়ে। তাই পুকুর পাড়ের ঝোপ-ঝাড় থাকলে তা পরিস্কার করতে হবে। এর পাশাপাশি পুকুর পাড়ের বড় গাছের ডাল পালা (যদি থাকে) কেটে পরিস্কার করতে হবে।
  4. পুকুর প্রস্তুত করন: পুকুর থেকে আশানুরূপ মাছ পেতে হলে শুরুতেই পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে।
    • পুকুর শুকানো: পুকুরের সমস্ত পানি সেচে ফেলে দিয়ে পুকুরের তলদেশ রোদে ভাল ভাবে শুকাতে নিতে হবে। যাতে করে পুকুরের তলায় ফাটল ধরে। এতে করে পুকুরের তলায় জমে থাকা ক্ষতিকর গ্যাস ও রোগ জীবাণু দূর হয়ে যাবে। এছাড়াও পুরাতন পুকুরের গভীর কাদার স্তর থাকে যা শুকিয়ে শক্ত হবে। পুকুর শুকানোর এই কাজটি বর্ষার আগেই করতে হবে।
    • চুনের ব্যবহার: মাছের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার জন্য পুকুরে চুন ব্যবহার করা হয়। চুন পানির পরিবেশ ঠিক রাখে, বিষাক্ত গ্যাস দূর করে এবং মাছের রোগ বালাই দূর করতে সাহায্য করে। জাল টানা, বিষ প্রয়োগ বা পুকুর শুকানোর ১-২ দিনের মধ্যে পুকুরে চুন প্রয়োগ করতে হয়।
    • সার প্রয়োগ: পুকুর শুকানো হয়ে গেলে, পুকুরের সকল জায়গায় পরিমান মত জৈব ও রাসায়নিক সার ছিটিয়ে দিতে হবে। সার ব্যবহার করার পর পরই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
    • সার ব্যবহারের পর ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপন্ন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
  5. পুকুরে পোনা ছাড়া: পুকুরে পোনা ছাড়ার আগে পুকুরের পানিতে ঔষধের বিষক্রিয়া আছে কিনা এবং মাছের প্রাকৃতিক খাবার তৈরী হল কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
    • অনাকাঙ্খিত বা রাক্ষুসে মাছ দমনের জন্য যদি পুকুরে বিষ দেওয়া হয় তাহলে সেই পুকুরে পোনা ছাড়ার আগে অবশ্যই পানির বিষক্রিয়া পরীক্ষা করে নিতে হবে।
    • এর জন্য পুকুরে একটি হাপা বা মশারী স্থাপন করে তার মধ্যে ৫-১০ টি মাছের পোনা ছেড়ে দিয়ে ২৪ ঘন্টা পর্যাবেক্ষনে রাখতে হবে।
    • যদি পোনা মাছ মারা না যায় তাহলে পোনা ছাড়া যাবে। আর যদি পোনা মারা যায় তাহলে আরো ৭ দিন অপেক্ষা করে পুনরায় একই পদ্ধতিতে পানি পরীক্ষা করে নিতে হবে।

ব্রিকেট মাছের খাদ্য ব্যবস্থা

ব্রিকেট মাছ ছোট অবস্থায় শ্যাওলা খেয়ে জীবন ধারন করে। যেমন: সোনালি বাদামী শেত্তলা, সবুজ শেত্তলা, হলুদ সবুজ শেত্তলা এবং নীল সবুজ শেত্তলা খায়। ব্রিকেট মাছ পরিণত বয়সে ফাইটোপ্লাঙ্কটন, পচা জলজ উদ্ভিদ খায়। পুকুরে সম্পূরক খাদ্য হিসেবে খৈল, কুঁড়া, গমের ভূষি দেয়া যেতে পারে।

ব্রিকেট মাছ সাধারনত কোনো ফিড খায না প্লাঙ্কটন বা জলজ উদ্ভিদ খায়। যদি আপনার পুকুরে পর্যাপ্ত প্লাঙ্কটন থাকে তাহলে বাড়তি কোনো খাবার দিতে হবে না। তবে পুকুরে যদি প্লাঙ্কটন না থাকে তাহলে গুড় ও গোবর মিশিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে এবং খৈল দিতে হবে।

মাছ ধরা ও বাজারজাত করন

ব্রিকেট মাছ অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল একটি মাছ। প্রথম বছর প্রতিটি মাছের গড় ওজন প্রায় দেড় কেজি হয়ে থাকে এবং দ্বিতীয় বছরে ৪-৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তার পরে অবশ্য বৃদ্ধির হার কমে যায়, তাই দেড় থেকে দুই বছরের ব্রিকেট মাছ ধরে বাজারজাত করা উত্তম। সর্বসাধারণের কাছে ব্রিকেট মাছের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ব্রিকেট মাছের রেসিপি

উপকরন:

ব্রিকেট মাছ রান্না করার জন্য যে যে উপকরণ লাগবে তা নিচে তুলে ধরা হলো-
  • ব্রিকেট মাছ হাফ কেজি
  • মাঝারি সাইজের দুইটা/ তিনটা পেঁয়াজ কুঁচি
  • বড়ো সাইজের ১টা টমেটো কুচি
  • হাফ চা চামচ আদা বাটা
  • এক চা চামচ রসুন বাটা
  • এক চা চামচ চিনি
  • হাফ চা চামচ মরিচ গুড়া
  • হাফ চা চামচের কম হলুদ গুড়া
  • হাফ চা চামচ জিরা গুড়া
  • হাফ চা চামচ ধনে গুড়া
  • এক চা চামচ গরম মশলা গুড়ো
  • হাফ চা চামচ গোটা জিরে
  • পরিমান মত লবন
  • ৪/৫ টেবিল চামচ তেল
  • দুই/তিনটা কাঁচা মরিচ
  • পরিমান মত পানি
  • দুটো তেজ পাতা

নির্দেশাবলী:

ব্রিকেট মাছ রান্না করার জন্য নিচের নির্দেশাবলী ফলো করতে পারেন। এই পদ্ধতিতে মাছ রান্না করলে বাসার ছোট বড় সবাই খুব পছন্দ করবে।
  • প্রথমে ব্রিকেট মাছগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিন, তারপর সামান্য লবণ ও হলুদ দিয়ে ভালো করে মেখে নিন।
  • তারপর একটি ছোট পাত্রে অল্প পরিমাণ পানি নিয়ে তাতে "গরম মশলা গুঁড়া" বাদে বাকি সব ধরনের মশলা একসাথে মিশিয়ে নিন।
  • এর পর মাছগুলোকে তেলে ভেজে নিতে হবে।
  • ভাজা মাছগুলো আলাদা পাত্রে রেখে, মাছ ভাজা তেলে আরও কিছুটা তেল দিয়ে গরম করে নিন।
  • তারপর আস্ত জিরা ও তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে তার মধ্যে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে হালকা বাদামি করে ভেজে নিন।
  • এরপর তার মধ্যে বেটে রাখা আদা-রসুন ও টমেটো কুচি দিয়ে ভেজে নিয়ে তাতে স্বাদমতো লবন ও গুলে রাখা মশলাগুলো দিয়ে ভাল করে কষিয়ে নিন।
  • মশলা কষানো হয়ে গেলে তার মধ্যে সামান্য পরিমাণে পানি দিয়ে ভাল করে ফুটিয়ে নিয়ে তার মধ্যে ভেজে রাখা মাছ গুলো দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন।
  • তারপর ঝোল ফুটে গামাখা হয়ে আসলে তার মধ্যে গরম মশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url